তারাপ্রসন্নের কীর্তি

তখন তারাপ্রসন্ন একখানি ‘গৌড়বার্তাবহ’ আনিয়া গৃহিণীর ক্রোড়ে মেলিয়া দিলেন। পাঠ করিয়া তিনি মনে মনে সম্পাদকের অক্ষয় ধনপুত্র কামনা করিলেন, এবং তাঁহার লেখনীর মুখে মানসিক পুষ্পচন্দন-অর্ঘ্য উপহার দিলেন। পাঠ সমাপন করিয়া আবার স্বামীর মুখের দিকে চাহিলেন।

স্বামী তখন ‘নবপ্রভাত’ আনিয়া খুলিয়া দিলেন। পাঠ করিয়া আনন্দবিহ্বলা দাক্ষায়ণী আবার স্বামীর মুখের প্রতি প্রত্যাশাপূর্ণ স্নিগ্ধনেত্র উত্থাপিত করিলেন।

তখন তারাপ্রসন্ন একখণ্ড ‘যুগান্তর’ বাহির করিলেন। তাহার পর? তাহার পর ‘ভারতভাগ্যচক্র’। তাহার পর? তাহার পর ‘শুভজাগরণ’। তাহার পর ‘অরুণালোক’। তাহার পর ‘সংবাদতরঙ্গভঙ্গ’। তাহার পর— আশা, আগমনী, উচ্ছ্বাস, পুষ্পমঞ্জরী, সহচরী, সীতা-গেজেট, অহল্যালাইব্রেরী-প্রকাশিকা, ললিত-সমাচার, কোটাল, বিশ্ববিচারক, লাবণ্যলতিকা। হাসিতে হাসিতে গৃহিণীর আনন্দাশ্রু পড়িতে লাগিল।

চোখ মুছিয়া আর-একবার স্বামীর কীর্তিরশ্মিসমুজ্জ্বল মুখের দিকে চাহিলেন- স্বামী বলিলেন, “এখনো অনেক কাগজ বাকি আছে।”

দাক্ষায়ণী বলিলেন, “সে বিকালে দেখিব, এখন অন্য খবর কী বলো।”

তারাপ্রসন্ন বলিলেন, “এবার কলিকাতায় গিয়া শুনিয়া আসিলাম, লাটসাহেবের মেম একখানা বই বাহির করিয়াছে কিন্তু তাহাতে বেদান্তপ্রভাকরের কোনো উল্লেখ করে নাই।”

দাক্ষায়ণী বলিলেন, “আহা, ও-সব কথা নয়— আর কী আনলে বলো-না।”

তারাপ্রসন্ন বলিলেন, “কতকগুলো চিঠি আছে।”

তখন দাক্ষায়ণী স্পষ্ট করিয়া বলিলেন, “টাকা কত আনলে।”

তারাপ্রসন্ন বলিলেন, “বিধুভূষণের কাছে পাঁচ টাকা হাওলাত করে এনেছি।”

অবশেষে দাক্ষায়ণী যখন সমস্ত বৃতান্ত শুনিলেন তখন পৃথিবীর সাধুতা সম্বন্ধে তাঁহার সমস্ত বিশ্বাস বিপর্যস্ত হইয়া গেল। নিশ্চয় দোকানদারেরা তাঁহার স্বামীকে ঠকাইয়াছে এবং বাংলাদেশের সমস্ত ক্রেতা ষড়যন্ত্র করিয়া দোকানদারদের ঠকাইয়াছে।

অবশেষে সহসা মনে হইল, যাহাকে নিজের প্রতিনিধি করিয়া স্বামীর সহিত পাঠাইয়াছিলেন সেই বিধুভূষণ দোকানদারদের সহিত তলে তলে যোগ দিয়াছে— এবং যত বেলা যাইতে লাগিল ততই তিনি পরিষ্কার বুঝিতে পারিলেন, ওপাড়ার বিশ্বম্ভর চাটুজ্যে তাঁহার স্বামীর পরম শত্রু নিশ্চয়ই এ-সমস্ত তাঁহারই চক্রান্তে ঘটিয়াছে। তাই বটে, যেদিন তাঁহার স্বামী কলিকাতায় যাত্রা করেন তাহার দুই দিন পরেই বিশ্বম্ভরকে বটতলায় দাঁড়াইয়া কানাই পালের সহিত কথা কহিতে দেখা গিয়াছিল— কিন্তু বিশ্বম্ভর মাঝে মাঝে প্রায়ই কানাই পালের সহিত কথাবার্তা কয় না কি, এইজন্যে তখন কিছু মনে হয় নাই, এখন সমস্ত জলের মতো বুঝা যাইতেছে।

এ দিকে দাক্ষায়ণীর সাংসারিক দুর্ভাবনা ক্রমেই বাড়িতে লাগিল। যখন অর্থসংগ্রহের এই একমাত্র সহজ উপায় নিষ্ফল হইল তখন আপনার কন্যাপ্রসবের অপরাধ তাঁহাকে চতুর্গুণ দগ্ধ করিতে লাগিল। বিশ্বম্ভর বিধুভূষণ অথবা বাংলাদেশের অধিবাসীদিগকে এই অপরাধের জন্য দায়িক করিতে পারিলেন না— সমস্তই একলা নিজের স্কন্ধে তুলিয়া লইতে হইল, কেবল যে-মেয়েরা জন্মিয়াছে এবং জন্মিবে তাহাদিগকেও কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ অংশ দিলেন। অহোরাত্র মুহূর্তের জন্য তাঁহার মনে আর শান্তি রহিল না।

আসন্নপ্রসবকালে দাক্ষায়ণীর শারীরিক অবস্থা এমন হইল যে, সকলের বিশেষ আশঙ্কার কারণ হইয়া দাঁড়াইল। নিরুপায় তারাপ্রসন্ন পাগলের মতো হইয়া বিশ্বম্ভরের কাছে গিয়া বলিল, “দাদা, আমার এই খানপঞ্চাশেক বই বাঁধা রাখিয়া যদি কিছু টাকা দাও তো আমি শহর হইতে ভালো দাই আনাই।”