গুপ্তধন
গোলকধাঁধার মতো, বারবার বাধা পাইতে লাগিল। অবশেষে ঘুরিয়া ঘুরিয়া ক্লান্ত হইয়া এক জায়গায় শুইয়া পড়িল এবং নিদ্রা আসিতে বিলম্ব হইল না।

ঘুম হইতে যখন জাগিল তখন রাত্রি কি দিন কি কত বেলা তাহা জানিবার কোনো উপায় ছিল না। অত্যন্ত ক্ষুধা বোধ হইলে মৃত্যুঞ্জয় চাদরের প্রান্ত হইতে চিঁড়া খুলিয়া লইয়া খাইল। তাহার পর আর-একবার হাৎড়াইয়া সুরঙ্গ হইতে বাহির হইবার পথ খুঁজিতে লাগিল। নানা স্থানে বাধা পাইয়া বসিয়া পড়িল। তখন চিৎকার করিয়া ডাকিল, “ওগো সন্ন্যাসী, তুমি কোথায়।”

তাহার সেই ডাক সুরঙ্গের সমস্ত শাখা প্রশাখা হইতে বারংবার প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। অনতিদূর হইতে উত্তর আসিল, “আমি তোমার নিকটেই আছি— কী চাও বলো।”

মৃত্যুঞ্জয় কাতরস্বরে কহিল, “কোথায় ধন আছে আমাকে দয়া করিয়া দেখাইয়া দাও।”

তখন আর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। মৃত্যুঞ্জয় বারংবার ডাকিল, কোনো সাড়া পাইল না।

দন্ড প্রহরের দ্বারা অবিভক্ত এই ভূতলগত চিররাত্রির মধ্যে মৃত্যুঞ্জয় আর-একবার ঘুমাইয়া লইল। ঘুম হইতে আবার সেই অন্ধকারের মধ্যে জাগিয়া উঠিল। চিৎকার করিয়া ডাকিল, “ওগো, আছ কি।”

নিকট হইতেই উত্তর পাইল, “এইখানেই আছি। কী চাও।”

মৃত্যুঞ্জয় কহিল, “আমি আর-কিছু চাই না— আমাকে এই সুরঙ্গ হইতে উদ্ধার করিয়া লইয়া যাও।”

সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি ধন চাও না? ”

মৃত্যুঞ্জয় কহিল, “না, চাহি না।”

তখন চক্‌মকি ঠোকার শব্দ উঠিল এবং কিছুক্ষণ পরে আলো জ্বলিল।

সন্ন্যাসী কহিলেন, “তবে এসো মৃত্যুঞ্জয়, এই সুরঙ্গ হইতে বাহিরে যাই।”

মৃত্যুঞ্জয় কাতরস্বরে কহিল, “বাবা, নিতান্তই কি সমস্ত ব্যর্থ হইবে। এত কষ্টের পরেও ধন কি পাইব না।”

তৎক্ষণাৎ মশাল নিবিয়া গেল। মৃত্যুঞ্জয় কহিল, “কী নিষ্ঠুর।” বলিয়া সেইখানে বসিয়া পড়িয়া ভাবিতে লাগিল। সময়ের কোনো পরিমাণ নাই, অন্ধকারের কোনো অন্ত নাই। মৃত্যুঞ্জয়ের ইচ্ছা করিতে লাগিল, তাহার সমস্ত শরীর-মনের বলে এই অন্ধকারটাকে ভাঙিয়া চূর্ণ করিয়া ফেলে। আলোক আকাশ আর বিশ্বচ্ছবির বৈচিত্র্যের জন্য তাহার প্রাণ ব্যাকুল হইয়া উঠিল; কহিল, “ওগো সন্ন্যাসী, ওগো নিষ্ঠুর সন্ন্যাসী, আমি ধন চাই না, আমাকে উদ্ধার করো।”

সন্ন্যাসী কহিলেন, “ধন চাও না? তবে আমার হাত ধরো। আমার সঙ্গে চলো।”

এবারে আর আলো জ্বলিল না। এক হাতে যষ্টি ও এক হাতে সন্ন্যাসীর উত্তরীয় ধরিয়া মৃত্যুঞ্জয় ধীরে ধীরে চলিতে লাগিল। বহুক্ষণ ধরিয়া অনেক আঁকাবাঁকা পথ দিয়া অনেক ঘুরিয়া-ফিরিয়া এক জায়গায় আসিয়া সন্ন্যাসী কহিলেন, “দাঁড়াও।”

মৃত্যুঞ্জয় দাঁড়াইল। তাহার পরে একটা মরিচা-পড়া লোহার দ্বার খোলার উৎকট শব্দ শোনা গেল। সন্ন্যাসী মৃত্যুঞ্জয়ের হাত ধরিয়া কহিলেন, “এসো।”

মৃত্যুঞ্জয় অগ্রসর হইয়া যেন একটা ঘরে প্রবেশ করিল। তখন আবার চক্‌মকি ঠোকার শব্দ শোনা গেল। কিছুক্ষণ পরে যখন মশাল জ্বলিয়া উঠিল তখন এ কী আশ্চর্য দৃশ্য! চারি দিকে দেয়ালের গায়ে মোটা মোটা সোনার পাত ভূগর্ভরুদ্ধ কঠিন সূর্যালোকপুঞ্জের মতো স্তরে স্তরে সজ্জিত। মৃত্যুঞ্জয়ের চোখ দুটা জ্বলিতে লাগিল। সে পাগলের মতো বলিয়া উঠিল, “এ সোনা আমার— এ আমি কোনোমতেই ফেলিয়া যাইতে পারিব না।”

সন্ন্যাসী কহিলেন, “আচ্ছা, ফেলিয়া যাইয়ো না; এই মশাল রহিল— আর এই ছাতু চিঁড়া আর বড়ো এক-ঘটি জল রাখিয়া