প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
যেমন বলা অমনি সেই ঘরের ভাঙা ভিত্তি হইতে একটা পাথর গড়াইয়া পড়িল আর সেইসঙ্গে আর-একটি কী সচেতন পদার্থ ধপ্ করিয়া পড়িয়া চিৎকার করিয়া উঠিল। সন্ন্যাসী এই অকস্মাৎ শব্দে চমকিয়া উঠিতেই তাহার হাত হইতে মশাল পড়িয়া নিবিয়া গেল।
সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে।” কোনো উত্তর পাইলেন না। তখন অন্ধকারে হাৎড়াইতে গিয়া তাহার হাতে একটি মানুষের দেহ ঠেকিল। তাহাকে নাড়া দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে তুমি।”
কোনো উত্তর পাইলেন না। লোকটা অচেতন হইয়া গেছে।
তখন চক্ মকি ঠুকিয়া ঠুকিয়া সন্ন্যাসী অনেক কষ্টে মশাল ধরাইলেন। ইতিমধ্যে সেই লোকটাও সংজ্ঞাপ্রাপ্ত হইল, আর উঠিবার চেষ্টা করিয়া বেদনায় আর্তনাদ করিয়া উঠিল।
সন্ন্যাসী কহিলেন, “এ কী, মৃত্যুঞ্জয় যে! তোমার এ মতি হইল কেন।”
মৃত্যুঞ্জয় কহিল, “বাবা, মাপ করো। ভগবান আমাকে শাস্তি দিয়াছেন। তোমাকে পাথর ছুঁড়িয়া মারিতে গিয়া সামলাইতে পারি নাই— পিছলে পাথরসুদ্ধ আমি পড়িয়া গেছি। পা’টা নিশ্চয় ভাঙিয়া গেছে।”
সন্ন্যাসী কহিলেন, “আমাকে মারিয়া তোমার কী লাভ হইত।”
মৃত্যুঞ্জয় কহিল, “লাভের কথা তুমি জিজ্ঞাসা করিতেছ! তুমি কিসের লোভে আমার পূজাঘর হইতে লিখনখানি চুরি করিয়া এই সুরঙ্গের মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতেছ। তুমি চোর, তুমি ভণ্ড! আমার পিতামহকে যে সন্ন্যাসী ঐ লিখনখানি দিয়াছিলেন তিনি বলিয়াছিলেন, আমাদেরই বংশের কেহ এই লিখনের সংকেত বুঝিতে পারিবে। এই গুপ্ত ঐশ্বর্য আমাদেরই বংশের প্রাপ্য। তাই আমি এ কয়দিন না-খাইয়া না-ঘুমাইয়া ছায়ার মতো তোমার পশ্চাতে ফিরিয়াছি। আজ যখন তুমি বলিয়া উঠিলে ‘পাইয়াছি’ তখন আমি আর থাকতে পারিলাম না। আমি তোমার পশ্চাতে আসিয়া ঐ গর্তটার ভিতরে লুকাইয়া বসিয়া ছিলাম। ওখান হইতে একটা পাথর খসাইয়া তোমাকে মারিতে গেলাম, কিন্তু শরীর দুর্বল, জায়গাটাও অত্যন্ত পিছল— তাই পড়িয়া গেছি— এখন তুমি আমাকে মারিয়া ফেলো সেও ভালো— আমি যক্ষ হইয়া এই ধন আগলাইব— কিন্তু তুমি ইহা লইতে পারিবে না, কোনোমতেই না। যদি লইতে চেষ্টা কর, আমি ব্রাক্ষ্মণ, তোমাকে অভিশাপ দিয়া এই কূপের মধ্যে ঝাঁপ দিয়া পড়িয়া আত্মহত্যা করিব। এ ধন তোমার ব্রক্ষ্মরক্ত গোরক্ততুল্য হইবে— এ ধন তুমি কোনোদিন সুখে ভোগ করিতে পারিবে না। আমাদের পিতা পিতামহ এই ধনের উপরে সমস্ত মন রাখিয়া মরিয়াছেন— এই ধনের ধ্যান করিতে করিতে আমরা দরিদ্র হইয়াছি— এই ধনের সন্ধানে আমি বাড়িতে অনাথা স্ত্রী ও শিশুসন্তান ফেলিয়া আহারনিদ্রা ছাড়িয়া লক্ষ্মীছাড়া পাগলের মতো মাঠে ঘাটে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি— এ ধন তুমি আমার চোখের সম্মুখে কখনো লইতে পারিবে না।”