শেষের রাত্রি

“মণি যেন আমার ঘরে আসবার জন্য দরজা ঠেলছিল— কোনোমতেই দরজা এতটুকুর বেশি ফাঁক হল না, সে বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল,কিন্তু কিছুতেই ঢুকতে পারল না। মণি চিরকাল আমার ঘরের বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল। তাকে অনেক ক’রে ডাকলুম, কিন্তু এখানে তার জায়গা হল না।”

মাসি কিছু না বলিয়া চুপ করিয়া রহিলেন। ভাবিলেন, ‘যতীনের জন্য মিথ্যা দিয়া যে একটুখানি স্বর্গ রচিতেছিলাম সে আর টিঁকিল না। দুঃখ যখন আসে তাহাকে স্বীকার করাই ভালো— প্রবঞ্চনার দ্বারা বিধাতার মার ঠেকাইবার চেষ্টা করা কিছু নয়।’

“মাসি,তোমার কাছে যে স্নেহ পেয়েছি সে আমার জন্মজন্মান্তরের পাথেয়, আমার সমস্ত জীবন ভ’রে নিয়ে চললুম। আর-জন্মে তুমি নিশ্চয় আমার মেয়ে হয়ে জন্মাবে, আমি তোমাকে বুকে করে মানুষ করব।”

“বলিস কী যতীন, আবার মেয়ে হয়ে জন্মাব? নাহয়,তোরই কোলে ছেলে হয়েই জন্ম হবে— সেই কামনাই কর্ -না।”

“না, না, ছেলে না। ছেলেবেলায় তুমি যেমন সুন্দরী ছিলে তেমনি অপরূপ সুন্দরী হয়েই তুমি আমার ঘরে আসবে। আমার মনে আছে, আমি তোমাকে কেমন করে সাজাব।”

“আর বকিস্‌ নে, যতীন, বকিস্‌ নে— একটু ঘুমো।”

“তোমার নাম দেব লক্ষ্মীরানী।”

“ও তো একেলে নাম হল না।”

“না, একেলে নাম না। মাসি, তুমি আমার সাবেক-কেলে— সেই সাবেক কাল নিয়েই তুমি আমার ঘরে এসো।”

“তোর ঘরে আমি কন্যাদায়ের দুঃখ নিয়ে আসবে, এ কামনা আমি তো করতে পারি নে।”

“মাসি, তুমি আমাকে দুর্বল মনে কর?— আমাকে দুঃখ থেকে বাঁচাতে চাও? ”

“বাছা,আমার যে মেয়েমানুষের মন,আমিই দুর্বল— সেইজন্যেই আমি বড়ো ভয়ে ভয়ে তোকে সকল দুঃখ থেকে চিরদিন বাঁচাতে চেয়েছি। কিন্তু,আমার সাধ্য কী আছে। কিছুই করতে পারি নি।”

“মাসি, এ জীবনের শিক্ষা আমি এ জীবনে খাটাবার সময় পেলুম না। কিন্তু, এ সমস্তই জমা রইল, আসছে বারে মানুষ যে কী পারে তা আমি দেখাব। চিরটা দিন নিজের দিকে তাকিয়ে থাকা যে ফাঁকি, তা আমি বুঝেছি।”

“যাই বল, বাছা, তুমি নিজে কিছু নাও নি,পরকেই সব দিয়েছ।”

“মাসি, একটা গর্ব আমি করব, আমি সুখের উপরে জবরদস্তি করি নি— কোনোদিন এ কথা বলি নি, যেখানে আমার দাবি আছে সেখানে আমি জোর খাটাব। যা পাই নি তা কাড়াকাড়ি করি নি। আমি সেই জিনিস চেয়েছিলুম যার উপরে কারো স্বত্ব নেই –সমস্ত জীবন হাতজোড় করে অপেক্ষাই করলুম ; মিথ্যাকে চাই নি ব’লেই এতদিন এমন ক’রে বসে থাকতে হল— এইবার সত্য হয়তো দয়া করবেন। ও কে ও— মাসি,ও কে।”

“কই, কেউ তো না,যতীন।”

“মাসি, তুমি একবার ও ঘরটা দেখে এসো গে,আমি যেন— ”

“না, বাছা, কাউকে তো দেখলুম না।”

“আমি কিন্তু স্পষ্ট যেন—”

“কিচ্ছু না যতীন— ঐ যে ডাক্তারবাবু এসেছেন।”

“দেখুন,আপনি ওঁর কাছে থাকলে উনি বড়ো বেশি কথা কন। কয়রাত্রি এমনি ক’রে তো জেগেই কাটালেন। আপনি শুতে