শুভদৃষ্টি

নবীন স্থিরভাবে কহিলেন, “তা দেখাশোনা–”

কান্তি যেন দেখেন নাই, ভান করিয়া কহিলেন, “সেই একেবারে শুভদৃষ্টির সময়।”

নবীন গদ্‌গদকণ্ঠে কহিলেন, “আমার সুধা বড়ো সুশীলা মেয়ে, রাঁধাবাড়া ঘরকন্নার কাজে অদ্বিতীয়। তুমি যেমন না দেখিয়াই তাহাকে বিবাহ করিতে প্রস্তুত হইয়াছ তেমনি আশীর্বাদ করি, আমার সুধা পতিব্রতা সতীলক্ষ্মী হইয়া চিরকাল তোমার মঙ্গল করুক। কখনো মুহূর্তের জন্য তোমার পরিতাপের কারণ না ঘটুক।”

কান্তি আর বিলম্ব করিতে চাহিলেন না, মাঘ মাসেই বিবাহ স্থির হইয়া গেল।

পাড়ার মজুমদারদের পুরাতন কোঠাবাড়িতে বিবাহের স্থান নির্দিষ্ট হইয়াছে। বর হাতি চড়িয়া মশাল জ্বালাইয়া বাজনা বাজাইয়া যথাসময়ে আসিয়া উপস্থিত।

শুভদৃষ্টির সময় বর কন্যার মুখের দিকে চাহিলেন। নতশির টোপপর-পরা চন্দনচর্চিত সুধাকে ভালো করিয়া যেন দেখিতে পাইলেন না। উদ্‌বেলিত হৃদয়ের আনন্দে চোখে যেন ধাঁধা লাগিল।

বাসরঘরে পাড়ার সরকারি ঠানদিদি যখন বরকে দিয়া জোর করিয়া মেয়ের ঘোমটা খোলাইয়া দিলেন তখন কান্তি হঠাৎ চমকিয়া উঠিলেন।

এ তো সেই মেয়ে নয়। হঠাৎ বুকের কাছ হইতে একটা কালো বজ্র উঠিয়া তাঁহার মস্তিষ্ককে যেন আঘাত করিল, মুহূর্তে বাসরঘরের সমস্ত প্রদীপ যেন অন্ধকার হইয়া গেল এবং সেই অন্ধকারপ্লাবনে নববধূর মুখখানিকেও যেন কালিমালিপ্ত করিয়া দিল।

কান্তিচন্দ্র দ্বিতীয়বার বিবাহ করিবেন না বলিয়া মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন; সেই প্রতিজ্ঞা কি এমনি একটা অদ্ভুত পরিহাসে অদৃষ্ট তুড়ি দিয়া ভাঙিয়া দিল! কত ভালো ভালো বিবাহের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করিয়াছেন, কত আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবদের সানুনয় অনুরোধ অবহেলা করিয়াছেন; উচ্চকুটুম্বিতার আকর্ষণ, অর্থের প্রলোভন,রূপখ্যাতির মোহ সমস্ত কাটাইয়া অবশেষে কোন্‌-এক অজ্ঞাত পল্লীগ্রামে বিলের ধারে এক অজ্ঞাত দরিদ্রের ঘরে এতবড়ো বিড়ম্বনা, লোকের কাছে মুখ দেখাইবেন কী করিয়া।

শ্বশুরের উপরে প্রথমটা রাগ হইল। প্রতারক এক মেয়ে দেখাইয়া আর-এক মেয়ের সহিত আমার বিবাহ দিল। কিন্তু ভাবিয়া দেখিলেন, নবীন তো তাঁহাকে বিবাহের পূর্বে কন্যা দেখাইতে চান নাই এমন নয়, তিনি নিজেই দেখিতে অসম্মত হইয়াছিলেন। বুদ্ধির দোষে যে এতবড়ো ঠকাটা ঠকিয়াছেন সে লজ্জার কথাটা কাহারও কাছে প্রকাশ না করাই শ্রেয়ঃ বিবেচনা করিলেন।

ঔষধ যেন গিলিলেন কিন্তু মুখের তারটা বিগড়াইয়া গেল। বাসরঘরের ঠাট্টা আমোদ কিছুই তাঁহার কাছে রুচিল না। নিজের এবং সর্বসাধারণের প্রতি রাগে তাঁহার সর্বাঙ্গ জ্বলিতে লাগিল।

এমন সময় হঠাৎ তাঁহার পার্শ্ববর্তিনী বধূ অব্যক্ত ভীত স্বরে চমকিয়া উঠিল। সহসা তাহার কোলের কাছ দিয়া একটা খরগোশের বাচ্ছা ছুটিয়া গেল। পরক্ষণেই সেদিনকার সেই মেয়েটি শশকশিশুর অনুসরণপূর্বক তাহাকে ধরিয়া গালের কাছে রাখিয়া একান্ত স্নেহে আদর করিতে লাগিল। “ঐ রে, পাগলি আসিয়াছে” বলিয়া সকলে তাহাকে চলিয়া যাইতে ঈঙ্গিত করিল। সে ভ্রূক্ষেপমাত্র না করিয়া ঠিক বরকন্যার সম্মুখে বসিয়া শিশুর মতো কৌতূহলে কী হইতেছে দেখিতে লাগিল। বাড়ির কোনো দাসী তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া লইবার চেষ্টা করিলে বর ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “আহা, থাক্‌-না, বসুক।”

মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার নাম কী।”

সে উত্তর না দিয়া দুলিতে লাগিল।

ঘরসুদ্ধ রমণী হাসিয়া উঠিল।

কান্তি আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার হাঁস-দুটি কত বড়ো হইল।”