রাজা
দেখতে পাই নে।

রাজা। নিজের আয়নায় দেখা যায় না— ছোটো হয়ে যায়। আমার চিত্তের মধ্যে যদি দেখতে পাও তো দেখবে, সে কত বড়ো! আমার হৃদয়ে তুমি যে আমার দ্বিতীয়, তুমি সেখানে কি শুধু তুমি!

সুদর্শনা। বলো বলো, এমনি করে বলো! আমার কাছে তোমার কথা গানের মতো বোধ হচ্ছে— যেন অনাদিকালের গান, যেন জন্ম-জন্মান্তর শুনে এসেছি। সে কি তুমিই শুনিয়েছ, আর আমাকেই শুনিয়েছ। না, যাকে শুনিয়েছ সে আমার চেয়ে অনেক বড়ো, অনেক সুন্দর; তোমার গানে সেই অলোকসুন্দরীকে দেখতে পাই— সে কি আমার মধ্যে, না তোমার মধ্যে। তুমি আমাকে যেমন করে দেখছ তাই একবার এক নিমেষের জন্য আমাকে দেখিয়ে দাও-না। তোমার কাছে অন্ধকার বলে কি কিছুই নেই। সেইজন্যেই তো তোমাকে কেমন আমার ভয় করে। এই-যে কঠিন কালো লোহার মতো অন্ধকার, যা আমার উপর ঘুমের মতো, মূর্ছার মতো, মৃত্যুর মতো, তোমার দিকে তার কিছুই নেই! তবে এ জায়গায় তোমার সঙ্গে আমি কেমন করে মিলব। না না, হবে না মিলন, হবে না। এখানে নয়, এখানে নয়। যেখানে আমি গাছপালা পশুপাখি মাটিপাথর সমস্ত দেখছি সেইখানেই তোমাকে দেখব।

রাজা। আচ্ছা, দেখো, কিন্তু তোমাকে নিজে চিনে নিতে হবে; কেউ তোমাকে বলে দেবে না— আর বলে দিলেই বা বিশ্বাস কী?

সুদর্শনা। আমি চিনে নেব, চিনে নেব, লক্ষ লোকের মধ্যে চিনে নেব। ভুল হবে না।

রাজা। আজ বসন্তপূর্ণিমার উৎসবে তুমি তোমার প্রাসাদের শিখরের উপরে দাঁড়িয়ো— চেয়ে দেখো— আমার বাগানে সহস্র লোকের মধ্যে আমাকে দেখবার চেষ্টা কোরো।

সুদর্শনা। তাদের মধ্যে দেখা দেবে তো?

রাজা। বার বার করে সকল দিক থেকেই দেখা দেব। সুরঙ্গমা!

সুরঙ্গমার প্রবেশ

সুরঙ্গমা। কী প্রভু!

রাজা। আজ বসন্তপূর্ণিমার উৎসব।

সুরঙ্গমা। আমাকে কী কাজ করতে হবে।

রাজা। আজ তোমার সাজের দিন, কাজের দিন নয়। আজ আমার পুষ্পবনের আনন্দে তোমাকে যোগ দিতে হবে।

সুরঙ্গমা। তাই হবে প্রভু!

রাজা। রানী আজ আমাকে চোখে দেখতে চান।

সুরঙ্গমা। কোথায় দেখবেন।

রাজা। যেখানে পঞ্চমে বাঁশি বাজবে, ফুলের কেশরের ফাগ উড়বে, জ্যোৎস্নায় ছায়ায় গলাগলি হবে— সেই আমাদের দক্ষিণের কুঞ্জবনে।

সুরঙ্গমা। সে লুকোচুরির মধ্যে কি দেখা যাবে! সেখানে যে হাওয়া উতলা, সবই চঞ্চল। চোখে ধাঁদা লাগবে না?

রাজা। রানীর কৌতূহল হয়েছে।