ঋণশোধ

বিজয়াদিত্য। আমি একলা যাব।

সেনাপতি। সে কী কথা?

বিজয়াদিত্য। সে তোমরা বুঝবে না। কবি কোথায়?

মন্ত্রী। তাঁকে আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

[উভয়ের প্রস্থান
শেখরের প্রবেশ

বিজয়াদিত্য। কবি!

শেখর। কী মহারাজ।

বিজয়াদিত্য। আমার পিতার সিংহাসনে এক বছর মাত্র আমি বসেছি – কিন্তু মনে হচ্ছে আমাদের বংশে যতদিন যত রাজা হয়েছে সকলের বয়স একত্র হয়ে আমার ঘাড়ে চেপে বসেছে। রাজাকে নবীন করবার কী উপায় আমাকে বলে দাও তো।

শেখর। সিংহাসন থেকে একবার মাটিতে পা ফেলেন দিকি! ওই মাটির মধ্যে জীবন-যৌবনের জাদুমন্ত্র রয়েছে।

বিজয়াদিত্য। আমার সিংহাসনের খাঁচার দরজা আমি চিরদিনের মতো খুলে রাখতে চাই – যাতে মাটির সঙ্গে আমার সহজ আনাগোনা চলে।

শেখর। যাতে শিউলির মালার সঙ্গে আপনার মুক্তোর মালার অদল-বদল হয়! তা হলে এই শরৎকালে আপনার ওই রাজবেশটা একবার খোলেন— আপন বলে চিনতে কারও ভুল হবে না।

বিজয়াদিত্য। আছে আমার সন্ন্যাসীর বেশ –ধুলোর সঙ্গে তার সুর মেলে। কবি তোমাকেও কিন্তু আমার সঙ্গে যেতে হবে।

শেখর। না মহারাজ, আমাকে যদি সঙ্গে নেন তাহলে আপনার ’পরে মন্ত্রী আর সেনাপতির বিষম অশ্রদ্ধা হবে, আর আমার ’পরে হবে রাগ।

বিজয়াদিত্য। ঠিক বটে। মন্ত্রীর মনে এই বড়ো ক্ষোভ যে, রাজত্ব পাবার যে পিতৃঋণ, সে শোধ করবার জন্যে আমার মন নেই।

শেখর। আমার মস্ত দোষ এই যে, আমি কেবল স্মরণ করাই, এই-যে বিশ্ব আমাদের চিত্তে অমৃত ঢেলে দিচ্ছে তার ঋণ আমাদের শোধ করতে হবে।

বিজয়াদিত্য। অমৃতের বদলে অমৃত দিয়ে তবে তো সেই ঋণ শোধ করতে হয়। তোমার হাতে সেই শক্তি আছে। তোমার কবিতার ভিতর দিয়ে তুমি বিশ্বকে অমৃত ফিরিয়ে দিচ্ছ। কিন্তু আমার কী ক্ষমতা আছে বলো। আমি তো কেবলমাত্র রাজত্ব করি।

শেখর। প্রেমও যে অমৃত, মহারাজ। আজ সকালের সোনার আলোয় পাতায় পাতায় শিশির যখন বীণার ঝংকারের মতো ঝলমল করে উঠল তখন সেই সুরের জবাবটি ভালোবাসার আনন্দ ছাড়া আর কিছুতে নেই। আমার কথা যদি বলেন সেই আনন্দ আজ আমার চিত্তে অসীম বিরহ-বেদনায় উপছে পড়ছে –

গান
আজি   শরত তপনে প্রভাত স্বপনে
        কী জানি পরান কী যে চায়—
ওই শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে
        বিহগ বিহগী কী যে গায়।