ললাটের লিখন
আমার পজিটিভলি ভালো লাগে। ”

‘ ভালো লাগে ', সুধাংশু হো হো করে হেসে উঠল। বললে, “ মডার্‌ন আর্ট বুঝতে আমাদের সময় লাগবে। ”

বাঁশরি বললে, “ বিধাতার তুলিতে সাহস আছে, যাকে তিনি ভালো-দেখতে করতে চান তাকে সুন্দর করা দরকার মনে করেন না। তাঁর মিষ্টান্ন তিনি ছড়ান ইতর লোকদেরই পাতে। ”

সুধাংশু বললে, “ গাল খেলুম তোমার কাছে, এটা সইতে চেষ্টা করব। কিন্তু ভাগ্যে সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং দেন নি গাল। ” বলে সে ঘোড়দৌড় দেখতে চলে গেল। বাঁশরিকে সঙ্গে নিয়ে যাবে প্ল্যান ছিল মনে, সেটা ত্যাগ করলে।

 

পার্টি জমেছে বাগানে, সুষমার বাপ গিরিশ সেনের বাড়িতে। বাগানের দক্ষিণ দিকে তিনটে ঝাউগাছ চক্র করে দাঁড়িয়ে, তার তলায় কাঠের আসন, সেই আসনে বসে আছে পৃথ্বীশ।

এই দলের এরকম পার্টিতে পৃথ্বীশের এই প্রথম প্রবেশ। অনেক ভেবেছিল নিজের সাজ নিয়ে। যে এন্ডির চাদরটা পরেছে এখানে এসে হঠাৎ দেখতে পেলে তার এক কোণে মস্ত একটা কালির দাগ। চারি দিকে ফিটফাটের ফ্যাশন, তারি মাঝখানে কালিটা যেন চেঁচিয়ে উঠছে। অভ্যাগত শৌখিনদের মধ্যে ধুতিপরা মানুষও আছে কিন্তু চাদর কারো গায়েই নেই। পৃথ্বীশ নিজেকে বেখাপ বলে অনুভব করলে, স্বস্তি পেলে না মনে। কোণে বসে বসে দেখলে কেউ বা আলাপ করছে বাগানে বেড়াতে বেড়াতে, কেউ বা খেলছে টেনিস, কেউ বা টেবিলে সাজানো আহার্য ভোগ করছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। উঠে দাঁড়ানো বা চলে বেড়ানো ওর পক্ষে অসাধ্য হল। রাগ হচ্ছে বাঁশরির 'পরে। চক্রান্ত করে সেই ওকে এখানে এনে হাজির করেছে। আনবার একটা কারণও ঘটেছিল। সেটি বলি। ‘ বেমানান ' নাম দিয়ে কিছুদিন আগেই পৃথ্বীশ একটা ছোটগল্প লিখেছিল। বিষয়টা এই —

দেওঘরে নলিনাক্ষের মস্ত দো-মহলাবাড়ি। পুজোর ছুটিতে এক মহলে আশ্রয় নিয়েছে নবকান্ত মুখুজ্জেরা। তাদের মেয়েরা নিষ্ঠাবতী, মুখ্যভাবে দেবদর্শনে পুর্ণ এবং গৌণভাবে ইঁদারার জলে ক্ষুধাবৃদ্ধি এই দুটোই তাদের মনে প্রবল। বৈঠকখানা ঘর থেকে কার্পেট উঠিয়ে দিয়েছে, সেখানেও শুচিতা বিস্তারের জন্যে চলছে জল-ঢালাঢালি। এ দিকে অন্য মহলে মোরগ মাংস-লোলুপ নলিনাক্ষের দলদল। এই দলের একজন এম.এস্‌সি. পরীক্ষার্থী অপর দলের কোনো পূজাপরায়ণা কুমারীকে হৃদয় সমর্পণ করেছিল, তারই ট্র্যাজেডি এবং কমেডি খুব জোরালো রসালো ভাষায় বর্ণনা করেছে পৃথ্বীশ। এক পক্ষের পাঠক বাহবা দিয়েছিল প্রচন্ড জোরে, বলা বাহুল্য বাঁশরি সে পক্ষের নয়।

বাঁশরি বললে, “ দেখো পৃথ্বীশবাবু, তুমি যে ছুরি চালিয়েছ ওটা যাত্রার দলের ছুরি, কাঠের উপরে রাঙতা মাখানো, ওতে যারা ভোলে তারা পাড়াগেঁয়ে অজ্‌বুগ তাদের জন্য সাহিত্য নয়। ”

পৃথ্বীশ হেসে উড়িয়ে দেবার জন্য বললে, “ কাজ হয়েছে দেখছি, বিঁধছে বুকে। ”

“ আমাকে বেঁধে নি, বিঁধেছে তোমার খ্যাতির ভাগ্যকে। বানিয়ে গাল দেয় পাঁচালির দল, হাটের-আসরে লোক হাসাবার জন্যে, তুমি কি সেই দলের লিখিয়ে নাকি? তা হলে দন্ডবৎ। ”

পৃথ্বীশ গালটাকে অগ্রসর হয়ে মেনে নেবার জন্যে বললে, “ ভাষায় বলে খুরে দন্ডবৎ। এত দিনে খুর ধরা পড়ল বুঝি। ”

“ ধরা পড়ত না, যদি-না সিংহের থাবা চালাবার ভান করতে। একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, মশায়, যাকে নলিনাক্ষের দল বলে এত ইনিয়ে বিনিয়ে কলম চালিয়েছ তাকে তুমি সত্য করে জান কি?”

পৃথ্বীশ বললে, “ লেখার জন্যে জানবার দরকার করে না, বানিয়ে বলবার বিধিদত্ত অধিকার আছে লেখকের, আদালতের সাক্ষীর নেই। ”