প্রগতিসংহার
নয়, সে কলেজের প্রিন্সিপাল্‌কে এই পড়ার ব্যাঘাত নিয়ে নালিশ করতে পর্যন্ত তৈরি ছিল। হয়তো ছিল, কিন্তু তার তো কোনো দলিল পাওয়া গেল না।

এমনি করে একটার পর আর-একটা উৎপাত চলতেই লাগল। এই সমস্ত উপদ্রবের প্রধান পাণ্ডা ছিল নীহার।

একবার ডিগ্রি নিতে যাচ্ছিল যখন সুরীতি,তার পাশে এসে নীহার বললে, “কী গো গরবিনী, মাটিতে যে পা পড়ছে না! ”

সুরীতি মুখ বেঁকিয়ে বললে, “দেখুন, আপনি আমার নাম নিয়ে ঠাট্টা করবেন না।”

নীহার বললে, “তুমি বিদুষী হয়ে একে ঠাট্টা বলো, এ যে বিশুদ্ধ ক্লাসিক্যাল সাহিত্য থেকে কোটেশন করা! এমন সম্মান কি আর কোনো নামে হতে পারে! ”

“আমাকে আপনার সম্মান করতে হবে না।”

“সম্মান না করে বাঁচি কী করে!হে বিকচকমলায়তলোচনা, হে পরিণতশরচ্চন্দ্রবদনা,হে স্মিতহাস্যজ্যোৎস্নাবিকাশিনী, তোমাকে আদরের নামে ডেকে যে তৃপ্তির শেষ হয় না।”

“দেখুন, আপনি আমাকে রাস্তার মধ্যে যদি এরকম অপমান করেন, আমি প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ করব।”

“নালিশ করতে হয় কোরো, তবে অপমানের একটা সংজ্ঞা ঠিক করে দিয়ো। এর মধ্যে কোন্‌ শব্দটা অপমানের? বল তো আমি আরো চড়িয়ে দিতে পারি। বলব—হে নিখিলবিশ্ব-হৃদয়-উন্মাদিনী” —

রাগে লাল হয়ে সুরীতি দ্রুতপদে চলে গেল। তার পিছন দিকে খুব একটা হাসির ধ্বনি উঠল। ডাক পড়তে লাগল, “ফিরে চাও হে রোষারুণলোচনা, হে যৌবনমদমত্তমাতঙ্গিনী” —

তার পরের দিন ক্লাস আরম্ভ হবার মুখেই রব উঠল, “হে সরস্বতী-চরণ-কমল-দলবিহারিণী-গুঞ্জনমত্ত-মধুব্রতা, পূর্ণচন্দ্রনিভাননী” —

সুরীতি রেগে গিয়ে পাশের ঘরে সুপারিন্‌টেণ্ডেণ্ট্‌ গোবিন্দবাবুকে বললে, “দেখুন, আমাকে কথায় কথায় অপমান করলে আমি থাকব না।”

তিনি এসে বললেন ক্লাসের ছেলেদের, “তোমরা কেন ওকে এত উপদ্রব করছ।”

নীহার বললে, “এ’কে কি উপদ্রব বলে! যদি কেউ নালিশ করতে পারে, তবে পূর্ণচন্দ্রই করতে পারতেন যে তাঁকে আমি ঠাট্টা করেছি। আমাদের ক্লাসে যোগেশ বলে—ওগুলো বাদ দিয়ে শুধু ওকে নিভাননা বললেই হয়, কেননা কলমের নিভের মতন সুতীক্ষ্ম ওর মুখ। শুনে বরং আমি বলেছিলুম ‘ছি, এরকম করে বলতে নেই, ওঁরা হলেন বিদুষী’—কথাটা চাপা দিয়েছিলুম। কিন্তু পূর্ণচন্দ্রনিভাননাতে আমি তো দোষের কিছু দেখি নি।”

ছেলেরা বললে, “আপনি বিচার করে দেখুন, আমরা মনের আনন্দে আউড়ে গিয়েছিলুম—হে সরস্বতীচরণকমলদলবিহারিণী গুঞ্জনমত্তমধুব্রতা! প্রথমত কথাটা নিন্দার নয়, দ্বিতীয়ত সেটা যে ওরই প্রতি লক্ষ করে বলা এত বড়ো অহংকার ওর কেন হল। ঘরেতে আরও তো ছাত্রী আছে, তারা তো ছিল খুশি।”

সুপারিন্‌টেণ্ডেণ্ট্‌ বললেন, “অস্থানে অসময়ে এ রকম সম্ভাষণগুলো লোকে পরিহাস বলেই নেয়। দরকার কী বলা! ”

“দেখুন সার, মন যখন উতলা হয়ে ওঠে তখন কি সময় অসময়ের বিচার থাকে। তা ছাড়া আমাদের এ সম্ভাষণ যদি পরিহাসই হয়, তা হলে তো এটা কেউ গায়ে না নিয়ে হেসে উড়িয়ে দিতে পারতেন। আর আপনার কলেজে এত বড়ো বড়ো সব বিদুষী, এঁরা কি পরিহাসের উত্তরে পরিহাস করতেও জানেন না? এঁদের দন্তরুচিকৌমুদীতে কি হাস্যমাধুরী জাগবে না। তা হলে আমরা সব তৃষিত সুধাপিপাসু পুরুষগুলো বাঁচি কী করে।”