বিবিধ প্রসঙ্গ
শত শত পাঠকের ঘরের মধ্যে বসিয়া তাঁহাদের সহিত কথা কহিতেছি। আমি এই বঙ্গদেশের কত স্থানের কত শত পবিত্র গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিতে পারিয়াছি। আমি যাঁহাদের চিনি না তাঁহারা আমার কথা শুনিতেছেন, তাঁহারা আমার পাশে বসিয়া আছেন,আমার মনের ভিতরে চাহিয়া দেখিতেছেন। তাঁহাদের ঘরকন্নার মধ্যে আমি আছি, তাঁহাদের কত শত সুখ দুঃখের মধ্যে আমি জড়িত হইয়া গেছি! ইঁহাদের মধ্যে কেহই কি আমাকে ভালবাসেন নাই? কোন জননী কি তাঁহার স্নেহের শিশুকে স্তনদান করিতে করিতে আমার লেখা পড়েন নাই ও সেই সঙ্গে সেই অসীম স্নেহের কিছু ভাগ আমাকে দেন নাই? সুখে দুঃখে হাসি কান্নায় আমার মমতা,আমার স্নেহ, সহসা কি সান্ত্বনার মত কাহারও কাহারও প্রাণে গিয়া প্রবেশ করে নাই ও সেই সময়ে কি প্রীতিপূর্ণ হৃদয়ে দূর হইতে আমাকে বন্ধু বলিয়া তাঁহারা ডাকেন নাই? কেহ যেন না মনে করেন আমি গর্ব করিতেছি। আমার যাহা বাসনা তাহাই ব্যক্ত করিতেছি মাত্র। মনে মনে মিলন হয় এমন লোক সচরাচর কই দেখিতে পাই? এই জন্য মনের ভাবগুলিকে যথাসাধ্য সাজাইয়া চারি দিকে পাঠাইয়া দিতেছি যদি কাহারও ভাল লাগে! যাঁহারা আমার যথার্থ বন্ধু, আমার প্রাণের লোক,কেবলমাত্র দৈববশতই যাঁহাদের সহিত আমার কোনো কালে দেখা হয় নাই, তাঁহাদের সহিত যদি মিলন হয়! সেই সকল পরমাত্মীয়দিগকে উদ্দেশ করিয়া আমার এই প্রাণের ফুলগুলি উৎসর্গ করি।

আমি কল্পনা করিতেছি, পাঠকদের মধ্যে এইরূপ আমার কতকগুলি অপরিচিত বন্ধু আছেন, আমার হৃদয়ের ইতিহাস পড়িতে তাঁহাদের ভালো লাগিতেও পারে। তাঁহারা আমার লেখা লইয়া অকারণ তর্ক-বিতর্ক অনর্থক সমালোচনা করিবেন না, তাঁহারা কেবল আমাকে চিনিবেন ও পড়িবেন। যদি এ কল্পনা মিথ্যা হয় ত হৌক, কিন্তু ইহারই উপর নির্ভর করিয়া আমার লেখা প্রকাশ করি। নহিলে কেবলমাত্র শকুনি গৃধিনীদের দ্বারা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করিবার জন্য নির্মমতার অনাবৃত শ্মশানক্ষেত্রের মধ্যে নিজের হৃদয়খানা কে ফেলিয়া রাখিতে পারে?

আর, আমার পাঠকদিগের মধ্যে একজন লোককে বিশেষ করিয়া আমার এই ভাবগুলি উৎসর্গ করিতেছি। — এ ভাবগুলির সহিত তোমাকে আরো কিছু দিলাম, সে তুমিই দেখিতে পাইবে! সেই গঙ্গার ধার মনে পড়ে? সেই নিস্তব্ধ নিশীথ? সেই জ্যোৎস্নালোক? সেই দুই জনে মিলিয়া কল্পনার রাজ্যে বিচরণ? সেই মৃদু গম্ভীর স্বরে গভীর আলোচনা? সেই দুই জনে স্তব্ধ হইয়া নীরবে বসিয়া থাকা? সেই প্রভাতের বাতাস,সেই সন্ধ্যার ছায়া! এক দিন সেই ঘনঘোর বর্ষার মেঘ,শ্রাবণের বর্ষণ, বিদ্যাপতি গান? তাহারা সব চলিয়া গিয়াছে! কিন্তু আমার এই ভাবগুলির মধ্যে তাহাদের ইতিহাস লেখা রহিল। এই লেখাগুলির মধ্যে কিছু দিনের গোটাকতক সুখ দুঃখ লুকাইয়া রাখিলাম,এক-একদিন খুলিয়া তুমি তাহাদের স্নেহের চক্ষে দেখিও, তুমি ছাড়া আর কেহ তাহাদিগকে দেখিতে পাইবে না! আমার এই লেখার মধ্যে লেখা রহিল — এক লেখা তুমি আমি পড়িব, আর এক লেখা আর সকলে পড়িবে।