সৌন্দর্য সম্বন্ধে গুটিকতক ভাব
স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করিতে চাহে না, আমরা তাহার হস্তে স্বাধীনতা সমর্পণ করিয়া কৃতার্থ হই।

সৌন্দর্য ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করিয়া থাকে। ফুল এক বসন্তে অনাদৃত হইয়া দ্বিতীয় বসন্তে ফোটে। বহির্জগতে কত ফুল ঝরিয়া একটি ফল হয়–ফুল হইতে আমাদের অন্তর্জগতেও যে ফল জন্মে তাহাও এইরূপ বহুবিফলতার সন্তান।

কিন্তু ঈশ্বরেরর শক্তি ঈশ্বরের ঝড় অপেক্ষা করে না। সে যখন প্রবাহিত হয় তখনি অরণ্যপর্বত কাঁপিয়া উঠে-তেরুলতা ভূমিশায়ী হয়। তাহার ফল সদ্য সদ্য।

ধীরে ধীরে আমাদের পাষাণ হৃদয় গলাইয়া দিতেছে, পাশব বলের প্রতি আমাদের লজ্জা জন্মাইয়া দিতেছে–অথচ একটি কথাও কহিতেছে না, সে কে? সে এই অসীম ধৈর্যবান সৌন্দর্য।

সে কাড়িয়া লয় না, আনন্দ দান করিয়া যায়, লোকের প্রাণ আপনি বশ হয়। মানব সভ্যতার উচ্চতম শিক্ষাই এই–প্রেমের দ্বারা দুর্বলভাবে পশুবলের উপর জয়লাভ করো। সৌন্দর্য ছাড়া জগতের আর কোথাও তো এ কথা লিপিবদ্ধ হয় নাই। আর সকলেই মারামারি কাড়াকাড়ি করে, প্রেম স্নিগ্ধনেত্রে চাহিয়া থাকে, সহিয়া যায়।

যোগ্যতমের উদ্‌বর্তন–এই নিয়ম যদি আলোচনা করিয়া দেখা যায় তবে প্রতীতি হয় বলের অপেক্ষা সৌন্দর্যের টিকিবার শক্তি অধিক। কারণ, সৌন্দর্য কাহাকেও আঘাত করে না, সুতরাং জগতের আঘাত ইচ্ছা উদ্রেক করে না।

সৌন্দর্য ক্ষেত্রেই আমরা ঈশ্বরের সমকক্ষ। ক্ষমতায় তিনি কোথায় আমি কোথায়! যেখানে সৌন্দর্য সেখানে আমরা দেখিতে পাই ঈশ্বরও আমাদিগকে চাহিতেছেন।

বহির্জগতে সৌন্দর্য, অন্তর্জগতে প্রেম। ভয়ে, অভাববোধে কাজ চলে, আদান-প্রতিদানের নিয়মে কাজ চলে, প্রেম বাহুল্যমাত্র। এমন-কি, উহাতে কাজের ক্ষতিও হয়। প্রেম অনেক সময় আপন স্বাধীনতাগর্বে আমাদের কাজ বিগ্‌ড়াইয়া দেয়–তবু প্রকৃতি উহাকে ধ্বংস করিতে পারে না, শাসন করিয়া নির্জীব করিতে পারে না। থাকিয়া থাকিয়া প্রচণ্ডবলে প্রকৃতির বিরুদ্ধে সে বিদ্রোহ করিয়া বসে। এমন-কি, প্রকৃতির ন্যায্য শাসনও অনেক সময়ে তাহার অসহ্য বোধ হয়। সে যেন বলে, আমি দেবকুমার, পরিপূর্ণ অক্ষয় স্বাধীনতাই আমার পিতৃভবন-সেইখানকার জন্যই সর্বদা আমার প্রাণ কাঁদিতেছে–এই মর্ত্য প্রকৃতির শাসন আমি মানিব না। জগৎ কে, সমাজ কে, লোকাচার কে! আমি যদি বলি, যাও–আমি তোমাদিগকে মানিতে চাহি না, তবে বড়ো জোর, আমাকে প্রাণে বিনাশ করিতে পারে, কিন্তু আমার সেই প্রবল স্বাধীন ইচ্ছাকে তো বাঁধিতে পারে না! সেই প্রেমের, সেই স্বাধীনতার মধ্যে একটি মরণাতীত দৈবভাব জাজ্জ্বল্যরূপে অনুভব করিতে পারি বলিয়াই তাহার খাতিরে অনেক সময়ে প্রাণকে তুচ্ছজ্ঞান করি, নহিলে প্রাণটা বড়ো সামান্য জিনিস নহে!