একটি পুরাতন কথা
পশু পক্ষী কীট পতঙ্গ সবাই মিলিয়া সরিয়া পড়িবে। তেমনি কেবলমাত্র সষরভঢ়ভদতর উদ্দেশ্যেই সত্য বদ্ধ নহে। তাহার প্রভাব মনুষ্যসমাজের অস্থি মজ্জার মধ্যে সহস্র আকারে কার্য্য করিতেছে – একটি মাত্র উদ্দেশ্য-বিশেষের উপযোগী করিয়া যদি তাহার পরিবর্ত্তন কর, তবে সে আর আর শত সহস্র উদ্দেশ্যের পক্ষে অনুপযোগী হইয়া উঠিবে। যেখানে যত সমাজের ধ্বংস হইয়াছে এইরূপ করিয়াই হইয়াছে। যখনই মতিভ্রমবশতঃ একটি সঙ্কীর্ণ হিত সমাজের চক্ষে সর্ব্বেসর্ব্বা হইয়া উঠিয়াছে, এবং অনন্ত হিতকে সে তাহার নিকটে বলিদান দিয়াছে, তখনই সেই সমাজের মধ্যে শনি প্রবেশ করিয়াছে, তাহার কলি ঘনাইয়া আসিয়াছে। একটি বস্তা সর্ষপের সদগতি করিতে গিয়া ভরা নৌকা ডুবাইলে বাণিজ্যের যেরূপ উন্নতি হয় উপরি-উক্ত সমাজের সেইরূপ উন্নতি হইয়া থাকে। অতএব স্বজাতির যথার্থ উন্নতি যদি প্রার্থনীয় হয়, তবে কল কৌশল ধূর্ত্ততা চাণক্যতা পরিহার করিয়া যথার্থ পুরুষের মত, মানুষের মত, মহত্ত্বের সরল রাজপথে চলিতে হইবে; তাহাতে গম্যস্থানে পৌঁছিতে যদি বিলম্ব হয় তাহাও শ্রেয়, তথাপি সুরঙ্গপথে অতি সত্বরে রসাতলরাজ্যে গিয়া উপনিবেশ স্থাপন করা সর্ব্বথা পরিহর্ত্তব্য।

পাপের পথে ধ্বংসের পথে যে বড় বড় দেউড়ি আছে সেখানে সমাজের প্রহরীরা বসিয়া থাকে, সুতরাং সে দিক দিয়া প্রবেশ করিতে হইলে বিস্তর বাধা পাইতে হয়; কিন্তু ছোট খিড়্‌কির দুয়ারগুলিই ভয়ানক, সে দিকে তেমন কড়াক্কড় পাহারা নাই। অতএব, বাহির হইতে দেখিতে যেমনই হউক, ধ্বংসের সেই পথগুলিই প্রশস্ত।

একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। যখনই আমি মনে করি “লোকহিতার্থে যদি একটা মিথ্যা কথা বলি তাহাতে তেমন দোষ নাই” তখনই আমার মনে যে বিশ্বাস ছিল “সত্য ভাল”, সে বিশ্বাস সঙ্কীর্ণ হইয়া যায়, তখন মনে হয় “সত্য ভাল”, কেননা সত্য আবশ্যক। সুতরাং যখনই ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে কল্পনা করিলাম লোকহিতের জন্য সত্য আবশ্যক নহে, তখন স্থির হয় মিথ্যাই ভাল। সময়বিশেষে সত্য মন্দ, মিথ্যা ভাল, এমন যদি আমার মনে হয়, তবে সময়বিশেষেই বা তাহাকে বদ্ধ রাখি কেন? লোকহিতের জন্য যদি মিথ্যা বলি, ত আত্মহিতের জন্যই বা মিথ্যা না বলি কেন?

উত্তর– আত্মহিত অপেক্ষা লোকহিত ভাল।

প্রশ্ন– কেন ভাল? সময়বিশেষে সত্যই যদি ভাল না হয়, তবে লোকহিতই যে ভাল এ কথা কে বলিল?

উত্তর– লোকহিত আবশ্যক বলিয়া ভাল।

প্রশ্ন– কাহার পক্ষে আবশ্যক?

উত্তর– আত্মহিতের পক্ষেই আবশ্যক।

তদুত্তর– কই, তাহা ত সকল সময় দেখা যায় না। এমন ত দেখিয়াছি পরের অহিত করিয়া আপনার হিত হইয়াছে।

উত্তর– তাহাকে যথার্থ হিত বলে না।

প্রশ্ন– তবে কাহাকে বলে?

উত্তর– স্থায়ী সুখকে বলে।

তদুত্তর– আচ্ছা, সে কথা আমি বুঝিব। আমার সুখ আমার কাছে। ভালমন্দ বলিয়া চরম কিছুই নাই। আবশ্যক অনাবশ্যক লইয়া কথা হইতেছে; আপাততঃ অস্থায়ী সুখই আমার আবশ্যক বলিয়া বোধ হইতেছে। তাহা ছাড়া পরের অহিত করিয়া আমি যে সুখ কিনিয়াছি তাহাই যে স্থায়ী নহে তাহার প্রমাণ কি? প্রবঞ্চনা করিয়া যে টাকা পাইলাম তাহা যদি আমরণ ভোগ করিতে পাই, তাহা হইলেই আমার সুখ স্থায়ী হইল। ইত্যাদি ইত্যাদি।

এইখানেই যে তর্ক শেষ হয় তাহা নয়। এই তর্কের সোপান বাহিয়া উত্তরোত্তর গভীর হইতে গভীরতর গহ্বরে নামিতে পারা যায়– কোথাও আর তল পাওয়া যায় না, অন্ধকার ক্রমশঃই ঘনাইতে থাকে; তরণীর আশ্রয়কে হেয়জ্ঞানপূর্ব্বক প্রবল গর্ব্বে