সমাজ সংস্কার ও কুসংস্কার
সমাজ-সংস্কারক সম্প্রদান প্রথা পরিত্যাগ করিয়াছেন। তাঁহারা বলেন, 'মেয়ে কি একটা ঘটিবাটি যে, একজনের হাত হইতে আর-একজনের হাতে পড়িবে?' এ কী হৃদয়হীন কথা? জগতে ঘটিবাটির অধিকার ছাড়া আর কোনো প্রকারের অধিকার নাই কি? স্নেহ প্রেমের কোনো অধিকার নাই কি? মনুষ্য-সমাজে অরাজকতা উচ্ছৃঙ্খলতা কেন নাই? যার যা খুশি সে তা করে না কেন? তাহার কারণ মানুষের উপর মানুষের অধিকার আছে। পরস্পরের জন্য পরস্পরকে অনেকটা সহিয়া থাকিতে হয়, অনেকটা আত্মসংযম করিতে হয়। এই পরস্পরের প্রতি যে দৃষ্টি রাখা, এ কি কেবল সুবিধার শাসনেই হয়? তাহা নয়, সভ্য সমাজে হৃদয়ের শাসনই বলবান হইতে থাকে। আমি একটি জন্তুকে যত সহজে বধ করিতে পারি, একটি মানুষকে তত সহজে বধ করিতে পারি না, সমাজের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি দৃষ্টিপাত করাই কি তাহার কারণ? তাহা নয়। তাহার কারণ এই যে, একজন মানুষের হৃদয়ের উপর, দয়ার উপর আর একজন মানুষের অধিকার আছে, সেই অধিকার লঙ্ঘন করা অসভ্যতা, পাপ! এক জাতি বলিয়া মানুষের উপর মানুষের যেরূপ অধিকার আছে, তেমনি এক পরিবার বলিয়া পরিবারস্থ ব্যক্তিদিগের পরস্পরের প্রতি বেশি অধিকার আছে, সে অধিকার লঙ্ঘন করিলে সমাজে ঘোর উচ্ছৃঙ্খলতা ও পাপের সৃষ্টি হয়, আবার পরিবারস্থ বিশেষ ঘনিষ্ঠ-সম্পর্ক ব্যক্তির বিশেষ ঘনিষ্ঠ অধিকার আছে, এই-সকল অধিকারের সহিত ঘটিবাটির অধিকার কি তুলনীয়? অতএব মেয়ের উপরে বাপের অধিকার নাই এ কথা কী করিয়া বলা যায়? ইত্যাদি ইত্যাদি।

দ্বিতীয় পক্ষ। তাহা যেন বুঝিলাম, মানিলাম সম্প্রদান প্রথা অন্যায় নহে। কিন্তু ইহা হইতে এই প্রমাণ হইতেছে যে, সংস্কারকদিগের বুঝিবার ভুল হইয়াছিল। কিন্তু ইহাকে তো আর সাহেবিয়ানা বলা যায় না। কারণ সাহেবদের মধ্যে সম্প্রদান প্রথা আছে।

তৃতীয় পক্ষ। সাহেবদের মধ্যে কীরূপ প্রথা প্রচলিত তাহা আমি জানি না, সুতরাং সে বিষয়ে কিছু বলিতে পারি না। সকলেই স্বাধীন, সকলেরই স্বতন্ত্র অধিকার আছে, ইত্যাদি ভাব আমরা ইংরাজের কাছ হইতে পাইয়াছি, সেই-সকল সাহেবি মতের ধুলায় অন্ধ হইয়া দেশীয় ভাবকে তাড়াতাড়ি উপেক্ষা করিতে যাওয়া কতকটা সাহেবি-প্রিয়তার ফল। ইংরাজেরা যদি ঠিক ইহার উল্টা কথাটা বলিতেন, আমরা হয়তো ঠিক ইহার উল্টা আচরণ করিতাম। যাহাই হউক, ইহা দেখা যাইতেছে, নব্যদিগের হৃদয়ে এমন একটি ভাব প্রবেশ করিয়াছে, যাহার প্রভাবে কথায় কথায় অকাতরে তাঁহারা দেশীয় প্রথা ত্যাগ করিতে পারেন, তাহার প্রতি একটু দরদ থাকিলে যতটা সাবধানে যতটা বিবেচনা করিয়া কাজ করা যাইত, ততটা করা হয় না। একটা লম্বাচৌড়া মত শুনিবামাত্রই অমনি তড়িঘড়ি এক-একটা দিশি প্রথাকে নির্বাসন করিতে যাওয়ার ভাবটাই ভালো নহে।

প্রথম পক্ষ। আচ্ছা, যদি পূর্বোক্ত সংস্কারকগণ কন্যার উপরে পিতার বা স্ত্রীর উপর স্বামীর অধিকার বাস্তবিকই স্বীকার না করেন, তবে কেন তাঁহারা, কন্যা যতদিন অবিবাহিত থাকে ততদিন তাহাকে তাহার পিতার পদবী দেন ও বিবাহিত হইলে কেন তাহাকে তাহার স্বামীর পদবীতে ডাকেন? যথা, অবিবাহিত কন্যার নাম কমলমণি ঘোষ, বিবাহিত কন্যার নাম কমলমণি নন্দী। তাহার নিজের নামের স্থায়িত্ব নাই কেন? সে কি একটা জড় পদার্থ, তাহার কি এতটুকু স্বাতন্ত্র্য নাই যে যখন যাহাদের ঘরে যাইবে তখনই তাহাদের নাম গ্রহণ করিবে?

দ্বিতীয় পক্ষ। লেখিকা কী অর্থে 'স্বাতন্ত্র্য' শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন তাহা ঠিক বুঝা গেল না। স্ত্রীলোক বংশের পদবী গ্রহণ করিতে স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যের যে কী খর্বতা হয় তাহাও বুঝিতে পারি না। পুরুষরা তো বংশের উপাধি গ্রহণ করেন, সেইজন্য কি তাঁহাদের স্বাতন্ত্র্য বিন্দুমাত্র কমিয়াছে?

তৃতীয় পক্ষ। এ কেমনতরো খাপছাড়া উত্তর হইল কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। পদবী গ্রহণে তো স্বাতন্ত্র্যের খর্বতা হয় না, কিন্তু পদবী পরিবর্তনে হয়। যত দিন স্ত্রী ঘোষ-পিতার অধীনে আছে ততদিন সে ঘোষ, আর, যখন সে বোস-স্বামীর বাড়িতে গেল