বিজ্ঞতা
কাছে প্রচার করা, কিঞ্চিৎ হাতে রাখিয়া মত ব্যক্ত করা, নিজেকে ভারী এক জন মস্ত লোক মনে করা, এই-সকলকে তোমরা বিজ্ঞতার লক্ষণ বলিয়া জান। তোমরা সিংহাসনস্থ বড় বড় রাজা মহারাজার চেয়ে নিজেকে উঁচু মনে করিতেছ-তাহার কারণ, তোমাদের আত্মম্ভরিতা- নামক লাঙ্গুলের প্রসরটা অত্যন্ত অধিক-নিজ-রচিত কুণ্ডলিত লাঙ্গুল-সিংহাসনের উপর বসিয়া দূরবীক্ষণের উল্টা দিক দিয়া জগৎসংসারকে দেখিতেছ। তোমাদের শরীরের আয়তন অধিক নহে, কিন্তু লেজ হইতে মাপিলে অনেকটা হয়। বিজ্ঞতার হৃদয় যদি এতটা প্রশস্ত হয় যে পরকে আলিঙ্গন করিয়া ধরিলে তাহার বক্ষে স্থান কুলায়, কুঞ্চিতচর্ম্ম সংশয়ের নাম যদি বিজ্ঞতা না হয়, তবে সেই বিজ্ঞতা উপার্জ্জনের জন্য চেষ্টা করিব। তোমাদের বিজ্ঞতায় যে সূর্য্যের আলো নাই, বসন্তকাননের শ্যামল বর্ণ নাই। তোমাদের বিজ্ঞতা সমুদয় জগৎকে অবিশ্বাস করিয়া অবশেষে একটি দুই-হাত-পরিমাণ ডোবার মধ্যে নিজেকে বদ্ধ করিয়াছে ও আপনাকে সমুদ্রের চেয়ে গভীর মনে করিতেছে, চন্দ্র সূর্য্যের হাসিকে চপলতা জ্ঞান করিতেছে, অনবরত পচিয়া উঠিতেছে ও মুখটা আঁধার করিয়া সুগম্ভীর চেহারা বাহির করিতেছে। তোমাদের বিজ্ঞতার প্রাণটা একরত্তি, তাহাকে ছুঁইলেই কচ্ছপের মত সে নিজের পেটের মধ্যে প্রবেশ করে; তোমাদের বিজ্ঞতার হাসিতে কৃপণতা, তাহার ভাষায় দুর্ভিক্ষ, তাহার আলিঙ্গন কাঁকড়ার আলিঙ্গনের মত, জিনিষ কিনিয়া সে কাণাকড়ি দিয়া তাহার দাম শোধ করে! এ বিজ্ঞতা লইয়া তোমরাই গর্ব্ব কর।

যে বিজ্ঞ সদনুষ্ঠানকে উপহাস করে, তাহা অপেক্ষা যে সরল ব্যক্তি সদনুষ্ঠানে চেষ্টা করিয়া অকৃতকার্য হইয়াছে সে মহৎ; যে মশক হস্তীকে বিব্রত করিয়া তোলে সে মশক হস্তীর চেয়ে বড়ো নহে; যে পাঁকে সৎপথগামী সাধুর পা বসিয়া গেছে, সে পাঁকের জাঁক করিবার বিষয় কিছুই নাই। সংশয় করিয়া, বিদ্রূপ করিয়া, অসৎ অভিসন্ধি আবিষ্কার করিয়া অনেক বিজ্ঞ অনেক সৎকার্যকে অঙ্কুরে দলিত করিয়া দিয়াছেন, অনেক তরুণ হৃদয়ের নবীন আশাকে তাঁহাদের হাস্যের বিদ্যুতাঘাতে চিরকালের জন্য দগ্ধ করিয়াছেন, অনেক উন্মুখ প্রতিভাকে নিষ্ঠুর ভাবে পীড়ন করিয়া হয়তো পৃথিবীর এক-একটা শতাব্দীকে অনুর্ব্বর মরুময় করিয়া দিয়াছেন- ইহাঁরা যদি এই-সকল দলিত অঙ্কুর, দগ্ধ আশা, ভগ্ন হৃদয় স্তূপাকৃতি করিয়া নিজের কীর্ত্তিস্তম্ভ রচনা করেন, তবে কি কোনো পিরামিড আয়তনে তাহার সমকক্ষ হইতে পারে? রোগ দুর্ভিক্ষের সহোদর বিজ্ঞতা শ্মশানের ভস্ম দিয়া একটা উৎসবাগার নির্মাণ করিয়াছে, সেখানে অস্থিকঙ্কালের নৃত্য হইতেছে, হৃদয়শোণিতের মদ্যপান চলিতেছে, খরধার রসনাখড়্গে আশা-উদ্যমের বলি হইতেছে। আইস, যাহাদের হৃদয় আছে, আমরা প্রকৃতিমাতার উৎসবালয়ে যাই। সেখানে জীবনের অভিনয় হইতেছে, সেখানে সৌন্দর্যের উৎস উৎসারিত হইতেছে, সেখানে মাপাজোকা কার্পণ্য নাই, সেখানে বাঁকাচোরা অনুদারতা নাই– সেখানে দুইমুখা প্রাণ নাই। এ –সকল বিজ্ঞলোকদের সহিত আমাদের পোষাইবে না– আমরা ইহাদের চিনিতে পারিব না, ইহাদের কথা ভাল বুঝিতে পারিব না – ইহারা উপদেশ দিবার সময় বড়ো বড়ো নীতিকথা বলে, কিন্তু ইহাদের মনে পাপ আছে, ইহাদের সর্বাঙ্গে সংক্রামক রোগ।