বাড়ির আবহাওয়া
তাঁহার দক্ষিণের বাগানে, পুকুরের বাঁধা ঘাটে মাছ ধরিবার সভায়, তিনি মূর্তিমান দাক্ষিণ্যের মতো বিরাজ করিতেন। সৌন্দর্যবোধ ও গুণগ্রাহিতায় তাঁহার নধর শরীর-মনটি যেন ঢলঢল করিতে থাকিত। নাট্যকৌতুক আমোদ-উৎসবের নানা সংকল্প তাঁহাকে আশ্রয় করিয়া নব নব বিকাশলাভের চেষ্টা করিত। শৈশবের অনধিকারবশত তাঁহাদের সে-সমস্ত উদ্‌যোগের মধ্যে আমরা সকল সময়ে প্রবেশ করিতে পাইতাম না— কিন্তু উৎসাহের ঢেউ চারি দিক হইতে আসিয়া আমাদের ঔৎসুক্যের উপরে কেবলই ঘা দিতে থাকিত। বেশ মনে পড়ে, বড়দাদা একবার কী-একটা কিম্ভূত কৌতুকনাট্য (burlesque) রচনা করিয়াছিলেন— প্রতিদিন মধ্যাহ্নে গুণদাদার বড়ো বৈঠকখানাঘরে তাহার রিহার্সাল চলিত। আমরা এ-বাড়ির বারান্দায় দাঁড়াইয়া খোলা জানালার ভিতর দিয়া অট্টহাস্যের সহিত মিশ্রিত অদ্ভুত গানের কিছু কিছু পদ শুনিতে পাইতাম এবং অক্ষয় মজুমদার মহাশয়ের উদ্দাম নৃত্যেরও কিছু কিছু দেখা যাইত। গানের এক অংশ এখনো মনে আছে—

ও কথা     আর বোলো না, আর বোলো না,

বলছ বঁধু কিসের, ঝোঁকে —

এ বড়ো হাসির কথা, হাসির কথা,

হাসবে লোকে —

হাঃ হাঃ হাঃ হাসবে লোকে! —

এতবড়ো হাসির কথাটা যে কী তাহা আজ পর্যন্ত জানিতে পারি নাই— কিন্তু এক সময়ে জানিতে পাইব, এই আশাতেই মনটা খুব দোলা খাইত।

একটা নিতান্ত সামান্য ঘটনায় আমার প্রতি গুণদাদার স্নেহকে আমি কিরূপ বিশেষ ভাবে উদ্‌বোধিত করিয়াছিলাম সে কথা আমার মনে পরিতেছে। ইস্কুলে আমি কোনোদিন প্রাইজ নাই নাই, একবার কেবল সচ্চরিত্রের পুরস্কার বালিয়া একখানা ছন্দোমালা বই পাইয়াছিলাম। আমাদের তিনজনের মধ্যে সত্যই পড়াশুনায় সেরা ছিল। সে কোন-একবার পরীক্ষায় ভালোরূপ পাস করিয়া একটা প্রাইজ পাইয়াছিল সেদিন ইস্কুল হইতে ফিরিয়া গাড়ি হইতে নামিয়াই দৌড়িয়া গুণদাদাকে খবর দিতে চলিলাম। তিনি বাগানে বসিয়া ছিলেন। আমি দূর হইতেই চীৎকার করিয়া ঘোষণা করিলাম, ‘গুণদাদা, সত্য প্রাইজ পাইয়াছে’। তিনি হাসিয়া আমাকে কাছে টানিয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি প্রাইজ পাও নাই?” আমি কহিলাম, “না, আমি পাই নাই, সত্য পাইয়াছে।” ইহাতে গুণদাদা ভারি খুশি হইলেন। আমি নিজে প্রাইজ না পাওয়া সত্ত্বেও সত্যের প্রাইজ পাওয়া এত উৎসাহ করিতেছি, ইহা তাঁহার কাছে বিশেষ একটা সদ্‌গুণের পরিচয় বলিয়া মনে হইল। তিনি আমার সামনেই সে কথাটা অন্য লোকের কাছে বলিলেন। এই ব্যাপারের মধ্যে কিছুমাত্র গৌরবের কথা আছে, তাহা আমার মনেও ছিল না-হঠাৎ তাঁহার কাছে প্রশংসা পাইয়া আমি বিস্মিত হইয়া গেলাম। এইরূপে আমি প্রাইজ না পাওয়ার প্রাইজ ভালো কিন্তু পুরস্কার দান করা ভালো নহে— ছেলেরা বাহিরের দিকে তাকাইবে, আপনার দিকে তাকাইবে না ইহাই তাহাদের পক্ষে স্বাস্থ্যকর।

মধ্যাহ্নে আহারের পর গুণদাদা এ-বাড়িতে কাছারি করিতে আসিতেন, কাছারি তাঁহাদের একটা ক্লাবের মতোই ছিল— কাজের সঙ্গে হাস্যালাপের বড়োবেশি বিচ্ছেদ ছিল না গুণদাদা কাছারিঘরে একটা কৌচে হেলান দিয়ে বসিতেন— সেই সুযোগে আমি আস্তে


১ দ্র অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘরোয়া

২ বস্তুত, এই ‘অদ্ভুতনাট্য’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের রচনা। দ্র জ্যোতিস্মৃতি, পৃ ৭২

৩ মধুসূদন বাচস্পতি –প্রণীত; প্রকাশ ৩১ বৈশাখ ১২৭৫[১৮৬৮]