তপতী

কুমারসেন। আর তিনি চান আমাকে।

সুমিত্রা। কেন, তোমার সঙ্গে তাঁর কিসের বিরোধ।

কুমারসেন। আমার সঙ্গে বিরোধের স্পষ্ট কারণ যদি থাকত তা হলে সে কারণ দূর করলেই বিপদ কাটত। কারণ তাঁর অন্ধপ্রকৃতির মধ্যে, সেইজন্যে এত দুর্নিবার, এত ভয়ংকর।

সুমিত্রা। আমি যদি যাই তিনি কি তোমাকে মুক্তি দেবেন।

কুমারসেন। কিন্তু তুমি কী করে যাবে তাঁর কাছে? তুমি যে দেবতার। রাজ্যের কথা আর আমি ভাবি নে কিন্তু কাশ্মীরের দেবতার অপমান ঘটতে দিতে পারব না।

সুমিত্রা। কী করবে তুমি।

কুমারসেন। কিছু না পারি তো মরব। পাপকে ঠেকাবার জন্যে কিছু না করাই তো পাপ।

নেপথ্যে। মহারানী!

সুমিত্রা। এ কী, এ যে দেবদত্ত ঠাকুর!

দেবদত্তের প্রবেশ

দেবদত্ত। কয়েকদিন থেকে দর্শনের চেষ্টা করেছিলুম, আমার চেহারা দেখে তোমার অনুচরদের মনে সংশয় ঘোচে না। অশোকবনে হনুমানকে দেখে রাক্ষসরা যেরকম সন্দিগ্ধ হয়েছিল এদের সেই দশা। আজ এইমাত্র হঠাৎ কেন এরা প্রসন্ন হল জানি নে। ছাড়া পেয়েই দেখা করতে এসেছি। একটা নিবেদন আছে—শুনতেই হবে আমার কথা।

সুমিত্রা। বলো।

দেবদত্ত। আর সহ্য হয় না মহারানী। গ্রাম থেকে গ্রামে, নগর থেকে নগরে অগ্নিকাণ্ড দুর্ভিক্ষ রক্তপাত নারীনির্যাতন। পাপের নেশা জালন্ধরের সমস্ত সৈন্যকেই পেয়েছে— থামতে পারছে না, মাত্রা কেবলই বেড়ে চলেছে। আমি মহারাজকে গিয়ে অভিশাপ দিয়েছিলেম, বলেছিলেম, অহরহ যমরাজের কাছে প্রার্থনা করছি তিনি তোমাকে সরিয়ে নিয়ে যান। রাজা আমাকে কারারুদ্ধ করেছিলেন, প্রহরী দয়া করে ছেড়ে দিলে। আজ মহারাজকে কেউ নিষেধ করতে পারবেন না একমাত্র তুমি ছাড়া।

কুমারসেন। ঠাকুর, এমন কথা কী করে বলছ, সুমিত্রা যাবেন তাঁর কাছে? এ মন্দির থেকে ওঁর তো ফেরবার পথ নেই। এতে স্বর্গে মর্ত্যে ধিক্‌কার উঠবে যে।

দেবদত্ত। আমি জানি বড়োই কঠিন ব্যাপার, এও জানি রাজা এখন প্রকৃতিস্থ নন। তবু বলছি দেবী সুমিত্রা, আজ তুমি সকল মান-অপমান সুখ-দুঃখের অতীত—তুমি পবিত্র, পাপ তোমার কাছে কুণ্ঠিত হবে, তুমি এই বীভৎসের মধ্যে নির্বিকার চিত্তে নামতে পারো।

কুমারসেন। সুমিত্রার কী ঘটতে পারে না-পারে সে কথা ভাববার সময় আজ নেই— কিন্তু সুমিত্রা কাশ্মীরের দেবতাকে অপমান করে এখান থেকে চলে যাবে সে আমি ঘটতে দেব না। দেবতার ধন হরণ করে তাকে মানুষের ভোগের ভাণ্ডারে নিয়ে যাবে আমাদের বংশের কন্যা!

সুমিত্রা। ভাই কুমার, তাঁকে এইখানে আহ্বান করে আনব।

কুমারসেন। এইখানে? এই দেবালয়ে?

সুমিত্রা। আসুন এখানেই, নইলে তাঁর মুক্তি কিছুতেই হবে না। আমার এই শেষ কাজ, তাঁকে বাঁচাতে হবে — তাঁর মোহগ্রন্থি