শশাঙ্কর কাজের দরদ ঊর্মি একটুও বোঝে না। কখনো কখনো অত্যন্ত বাধা দেওয়ায় শশাঙ্কর কাছে তিরস্কার পেয়েছে। তার ফল এমন শোকাবহ হয়েছিল যে তার শোচনীয়তা অপসারণ করবার জন্যে শশাঙ্ককে দ্বিগুণ সময় দিতে হয়েছে। এক দিকে ঊর্মির চোখে বাষ্পসঞ্চার, অন্য দিকে অপরিহার্য কাজের তাড়া। তাই, সংকটে পড়ে অবশেষে বাড়ির বাইরে চেম্বারেই ওর সমস্ত কাজকর্ম সেরে আসতে চেষ্টা করে। কিন্তু অপরাহ্ন পেরোলেই সেখানে থাকা দুঃসহ হয়ে ওঠে। কোনো কারণে যেদিন বিশেষ দেরি করে সেদিন ঊর্মির অভিমান দুর্ভেদ্য মৌনের অন্তরালে দুরভিভব হয়ে ওঠে। এই রুদ্ধ অশ্রুতে কুহেলিকাচ্ছন্ন অভিমানটা ভিতরে ভিতরে শশাঙ্ককে আনন্দ দেয়। ভালোমানুষটির মতো বলে, ‘ঊর্মি, কথা কইবে না এ সত্যাগ্রহ রক্ষা করাই উচিত। কিন্তু দোহাই ধর্ম, খেলবে না এমন পণ তো ছিল না।’ তার পরে টেনিস-ব্যাট হাতে করে চলে আসে। খেলায় শশাঙ্ক জিতের কাছাকাছি এসে ইচ্ছে করেই হারে। নষ্ট সময়ের জন্য আবার পরের দিন সকালে উঠেই অনুতাপ করতে থাকে।
কোন- একটা ছুটির দিনে বিকালবেলায় শশাঙ্ক যখন ডান হাতে লাল-নীল পেন্সিল নিয়ে বাঁ আঙুলগুলো দিয়ে অকারণে চুল উস্কোখুস্কো করতে করতে আপিসের ডেস্কে বসে কোনো-একটা দুঃসাধ্য কাজের উপর ঝুঁকে পড়েছে, ঊর্মি এসে বলে, “তোমার সেই দালালের সঙ্গে ঠিক করেছি আজ আমাকে পরেশনাথের মন্দির দেখাতে নিয়ে যাবে। চলো আমার সঙ্গে। লক্ষ্মীটি।”
শশাঙ্ক মিনতি করে বলে, “না ভাই, আজ না, এখন আমার ওঠবার জো নেই।”
কাজের গুরুত্বে ঊর্মি একটুও ভয় পায় না। বলে, “অবলা রমণীকে অরক্ষিত অবস্থায় সবুজ-পাগড়ি-ধারীর হাতে সমর্পণ করে দিতে সংকোচ নেই, এই বুঝি তোমার শিভ্লরি!”
শেষকালে ওর টানাটানিতে শশাঙ্ক কাজ ফেলে যায় মোটর হাঁকিয়ে। এইরকম উৎপাত চলছে টের পেলে শর্মিলা বিষম বিরক্ত হয়। কেননা, ওর মতে পুরুষের সাধনার ক্ষেত্রে মেয়েদের অনধিকার প্রবেশ কোনোমতেই মার্জনীয় নয়। ঊর্মিকে শর্মিলা বরাবর ছেলেমানুষ বলেই জেনেছে। আজও সেই ধারণাটা ওর মনে আছে। তা হোক, তাই বলে আপিস-ঘর তো ছেলেখেলার জায়গা নয়। তাই, ঊর্মিকে ডেকে যথেষ্ট কঠিনভাবেই তিরস্কার করে। সে তিরস্কারের নিশ্চিত ফল হতে পারত, কিন্তু স্ত্রীর ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর শুনে শশাঙ্ক স্বয়ং দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে ঊর্মিকে আশ্বাস দিয়ে চোখ টিপতে থাকে। তাসের প্যাক দেখিয়ে ইশারা করে, ভাবখানা এই যে, ‘চলে এসো, আপিস-ঘরে বসে তোমাকে পোকার খেলা শেখাব।’ এখন খেলার সময় একেবারেই নয়, এবং খেলবার কথা মনে আনবারও সময় ও অভিপ্রায় ওর ছিল না। কিন্তু দিদির কঠোর ভর্ৎসনায় ঊর্মির মনে বেদনা লাগছে, এটা তাকে যেন ঊর্মির চেয়েও বেশি বাজে। ও নিজেই তাকে অনুনয়, এমন-কি, ঈষৎ তিরস্কার করে কাজের ক্ষেত্র থেকে সরিয়ে রাখতে পারত, কিন্তু শর্মিলা যে এই নিয়ে ঊর্মিকে শাসন করবে এইটে সহ্য করা ওর পক্ষে বড়ো কঠিন।
শর্মিলা শশাঙ্ককে ডেকে বলে, “তুমি ওর সব আবদার এমন করে শুনলে চলবে কেন। সময় নেই, অসময় নেই, তোমার কাজের লোকসান হয় যে।”