Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://rabindra-rachanabali.nltr.org)


য়ুরোপ-প্রবাসীর দশম পত্র, ৩
য়ুরোপ-প্রবাসীর দশম পত্র
ভারি ভারি। সে এক-এক সময়ে আমাকে এক-একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে। একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করছিল, “আচ্ছা, আঙ্ক্‌ল্‌ আর্থার, ইঁদুররা কী করে?” আঙ্ক্‌ল্‌ বললেন, “তারা রান্নাঘর থেকে চুরি করে খায়।” সে একটু ভেবে বললে, “চুরি করে? আচ্ছা, চুরি করে কেন?” আঙ্ক্‌ল্‌ বললেন, “তাদের খিদে পায় বলে।” শুনে টমের বড়ো ভালো লাগল না। সে বারবার শুনে আসছে যে, জিজ্ঞাসা না করে পরের জিনিস নেওয়া অন্যায়। আর-একটি কথা না বলে সে চলে গেল। যদি তার বোন কখনো কাঁদে, সে তাড়াতাড়ি এসে সান্ত্বনার স্বরে বলে, “Oh poor Ethel, don’t you cry! Poor Ethel! “ এথেলের মনে মনে জ্ঞান আছে যে, সে একজন লেডি। সে কেমন গম্ভীরভাবে কেদারায় ঠেস দিয়ে বসে। টমকে এক-এক সময়ে ভর্ৎসনা করে বলে, “আমাকে বিরক্ত করো না।” একদিন টম পড়ে গিয়ে কাঁদছিল। আমি তাকে বললেন, “ছি, কাঁদতে আছে!” অমনি এথেল আমার কাছে ছুটে এসে জাঁক করে বললে, “আঙ্ক্‌ল্‌ আর্থার, আমি একবার ছেলেবেলায় রান্নাঘরে পড়ে গিয়েছিলেম, কিন্তু কাঁদি নি।” ছেলেবেলায়!

মিস্টার ন—, ডাক্তারের আর এক ছেলে, বাড়িতে থাকেন কিন্তু তাঁকে দেখতে পাই নে। তিনি সমস্ত দিন আপিসে। আপিস থেকে এলেও তাঁর বড়ো একটা দেখা পাওয়া যায় না। তার কারণ মিস্‌ ই—র সঙ্গে তাঁর বিয়ের সম্বন্ধ। তাঁদের দু-জনে কোর্টশিপ চলছে। রবিবার দু-বেলা প্রেয়সীকে নিয়ে তাঁর চার্চে যেতে হয়। যখন বিকেলে একটু অবসর পান, প্রণয়িনীর বাড়িতে গিয়ে এক পেয়ালা চা খেয়ে আসেন। প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যেবেলা তাঁদের বাড়িতে তাঁর নেমন্তন্ন। এই রকমে তাঁর সময় ভারি অল্প। উভয়ে পরস্পরকে নিয়ে এমন সুখী আছেন যে, অবসরকাল কাটাবার জন্যে অন্য কোনো জীবের সঙ্গ তাঁদের আবশ্যক করে না। শুক্রবার সন্ধ্যেবেলায় যদি আকাশ ভেঙে পড়ে তবু মিস্টার ন—পরিষ্কার করে চুলটি ফিরিয়ে, পমেটম মেখে, কোট ব্রাস করে ফিটফাট হয়ে ছাতা হাতে বাড়ি থেকে বেরোবেনই। একবার খুব শীত পড়েছিল, আর তাঁর ভারি কাশি হয়েছিল; মনে করলেম, আজ বুঝি বেচারির আর যাওয়া হয় না। সাতটা বাজতে না বাজতেই দেখি তিনি ফিটফাট হয়ে নেবে এসেছেন।

যা হোক, আমার এই পরিবারের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। সেদিন মেজো মেয়ে আমাকে বলছিলেন যে, প্রথম যখন তাঁরা শুনলেন যে, একজন ভারতবর্ষীয় ভদ্রলোক তাঁদের মধ্যে বাস করতে আসছে, তাঁদের ভারি ভয় হয়েছিল। যেদিন আমার আসবার কথা সেই দিন মেজো ও ছোটো মেয়ে, তাঁদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় এক হপ্তা বাড়িতে আসেন নি। তার পর হয়তো যখন তাঁরা শুনলেন যে, মুখে ও সর্বাঙ্গে উল্কি নেই, ঠোঁট বিঁধিয়ে অলংকার পরে নি, তখন তাঁরা বাড়িতে ফিরে এলেন। ওঁরা বলেন যে প্রথম প্রথম এসে যদিও আমার সঙ্গে কথাবার্তা কয়েছিলেন তবুও দু-দিন পর্যন্ত আমার মুখ দেখেন নি। হয়তো ভয় হয়েছিল যে কী অপূর্ব ছাঁচে ঢালাই মুখই না জানি দেখবেন। তার পর যখন মুখ দেখলেন—তখন?

যা হোক, এই পরিবারে সুখে আছি। সন্ধ্যেবেলা আমোদে কেটে যায়—গান-বাজনা, বই পড়া। আর এথেল তার আঙ্ক্‌ল্‌ আর্থারকে মুহূর্ত ছেড়ে থাকতে চায় না।