অতএব ব্রহ্মকে পেতে হবে এ-কথাটা বলা ঠিক চলে না– আপনাকে দিতে হবে বলতে হবে। ওইখানেই অভাব আছে– সেইজন্যেই মিলন হচ্ছে না। তিনি আপনাকে দিয়েছেন, আমরা আপনাকে দিই নি। আমরা নানাপ্রকার স্বার্থের, অহংকারের, ক্ষুদ্রতার বেড়া দিয়ে নিজেকে অত্যন্ত স্বতন্ত্র, এমন কি, বিরুদ্ধ করে রেখেছি।
এইজন্যই বুদ্ধদেব এই স্বাতন্ত্র্যের অতি কঠিন বেষ্টন নানা চেষ্টায় ক্রমে ক্রমে ক্ষয় করে ফেলবার উপদেশ করেছেন। এর চেয়ে বড়ো সত্তা বড়ো আনন্দ যদি কিছুই না থাকে, তা হলে এই ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য নিরন্তর অভ্যাসে নষ্ট করে ফেলবার কোনো মানে নেই। কারণ, কিছুই যদি না থাকে তা হলে তো আমাদের এই অহং, এই ব্যক্তিগত বিশেষত্বই, একেবারে পরম লাভ– তা হলে একে আঁকড়ে না রেখে এত করে নষ্ট করব কেন?
কিন্তু আসল কথা এই যে, যিনি পরিপূর্ণরূপে নিজেকে দান করেছেন আমরাও তাঁর কাছে পরিপূর্ণরূপে নিজেকে দান না করলে তাঁকে প্রতিগ্রহ করাই হবে না। আমাদের দিকেই বাকি আছে।
তাঁর উপাসনা তাঁকে লাভ করবার উপাসনা নয়– আপনাকে দান করবার উপাসনা। দিনে দিনে ভক্তি-দ্বারা, ক্ষমা-দ্বারা, সন্তোষের দ্বারা, সেবার দ্বারা তাঁর মধ্যে নিজেকে মঙ্গলে ও প্রেমে বাধাহীনরূপে ব্যাপ্ত করে দেওয়াই তাঁর উপাসনা।
অতএব আমরা যেন না বলি যে তাঁকে পাচ্ছি নে কেন, আমরা যেন বলতে পারি তাঁকে দিচ্ছি নে কেন? আমাদের প্রতিদিনের আক্ষেপ হচ্ছে এই যে–
আমার যা আছে আমি, সকল দিতে
পারি নি তোমারে নাথ।
আমার লাজ ভয়, আমার মান অপমান
সুখ দুখ ভাবনা।
দাও দাও দাও, সমস্ত ক্ষয় করো, সমস্ত খরচ করে ফেলো, তা হলেই পাওয়াতে একেবারে পূর্ণ হয়ে উঠবে।
মাঝে রয়েছে আবরণ কত শত কত মতো–
তাই কেঁদে ফিরি, তাই তোমারে না পাই,
মনে থেকে যায় তাই হে মনের বেদনা।
আমাদের যত দুঃখ যত বেদনা সে কেবল আপনাকে ঘোচাতে পারছি নে বলেই– সেইটে ঘুচলেই যে তৎক্ষণাৎ দেখতে পাব আমার সকল পাওয়াকে চিরকালই পেয়ে বসে আছি।
উপনিষৎ বলেছেন, ব্রহ্ম তল্লক্ষ্য মূচ্যতে– ব্রহ্মকেই লক্ষ্য বলা হয়। এই লক্ষ্যটি কিসের জন্যে? কিছুকে আহরণ করে নিজের দিকে টানবার জন্যে নয়– নিজেকে একেবারে হারাবার জন্যে। শরবৎ তন্ময়ো ভবেৎ। শর যেমন লক্ষ্যের মধ্যে সম্পূর্ণ প্রবেশ করে তন্ময় হয়ে যায়, তেমনি করে তাঁর মধ্যে একেবারে আচ্ছন্ন হয়ে যেতে হবে।
এই তন্ময় হয়ে যাওয়াটা কেবল যে একটা ধ্যানের ব্যাপার আমি তা মনে করি নে। এটা হচ্ছে সমস্ত জীবনেরই ব্যাপার। সকল