শৈলজা একটু একটু করিয়া কথায় কথায় সমস্ত বৃত্তান্ত আগাগোড়া বাহির করিয়া লইল। সমস্ত কথা শোনা হইলে সে কহিল, “বোন, তোর দুঃখের কপাল, কিন্তু আমি এই কথা ভাবিতেছি, ভাগ্যে তুই রমেশবাবুর হাতে পড়িয়াছিলি। যাই বলিস, বেচারা রমেশবাবুর কথা মনে করিলে বড়ো দুঃখ হয়। আজ রাত অনেক হইল, কমল, তুই আজ ঘুমো। ক’দিন রাত জাগিয়া কাঁদিয়া মুখ কালি হইয়া গেছে। এখন কী করিতে হইবে, কাল সব ঠিক করা যাইবে।”
রমেশের লিখিত সেই চিঠি কমলার কাছে ছিল। পরদিন সেই চিঠিখানি লইয়া শৈলজা তাহার পিতাকে নিভৃত ঘরে ডাকিয়া পাঠাইল এবং চিঠি তাঁহার হাতে দিল। খুড়া চশমা চোখে তুলিয়া অত্যন্ত ধীরে ধীরে পাঠ করিলেন; তাহার পরে চিঠি মুড়িয়া, চশমা খুলিয়া কন্যকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাই তো, এখন কী কর্তব্য?”
শৈল কহিল, “বাবা, উমির কয়দিন হইতে সর্দিকাসি করিয়াছে, একবার নলিনাক্ষ ডাক্তারকে ডাকিয়া আনাও-না। কাশীতে তাঁহার আর তাঁর মার তো খুব নাম শোনা যায়। একবার তাঁকে দেখিই-না।”
রোগীকে দেখিবার জন্য ডাক্তার আসিল এবং ডাক্তারকে দেখিবার জন্য শৈল ব্যস্ত হইয়া উঠিল। কহিল, “কমল, আয়, শীঘ্র আয়।”
নবীনকালীর বাড়ি যে কমলা নলিনাক্ষকে দেখিবার ব্যগ্রতায় প্রায় আত্মবিস্মৃত হইয়া উঠিয়াছিল, সেই কমলা আজ লজ্জায় উঠিতে চায় না।
শৈল কহিল, “দেখ্ পোড়ারমুখী, আমি তোকে বেশিক্ষণ সাধিব না, তা আমি বলিয়া রাখিতেছি— আমার সময় নাই— উমির ব্যামো কেবল নামমাত্র, ডাক্তার বেশিক্ষণ থাকিবে না— তোকে সাধাসাধি করিতে গিয়া মাঝে হইতে আমার দেখা হইবে না।”
এই বলিয়া কমলাকে জোর করিয়া টানিয়া লইয়া শৈলজা দ্বারের অন্তরালে আসিয়া দাঁড়াইল। নলিনাক্ষ উমার বুক-পিঠ ভালো করিয়া পরীক্ষা করিয়া ওষুধ লিখিয়া দিয়া চলিয়া গেল।
শৈল কমলাকে কহিল, “কমল, বিধাতা তোকে যতই দুঃখ দিন, তোর ভাগ্য ভালো। এখন দুই-একদিন, বোন তোকে একটু ধৈর্য ধরিয়া থাকিতে হইবে— আমরা একটা ব্যবস্থা করিয়া দিতেছি। ইতিমধ্যে উমির জন্যে ঘন ঘন ডাক্তারের প্রয়োজন হইবে, অতএব নিতান্ত তোকে বঞ্চিত হইতে হইবে না।”
খুড়া একদিন এমন সময় বাছিয়া ডাক্তার ডাকিতে গেলেন যখন নলিনাক্ষ বাড়িতে থাকে না। চাকর কহিল, “ডাক্তারবাবু নাই।”
খুড়া কহিলেন, “মাঠাকরুন তো আছেন, তাঁহাকে একবার খবর দাও। বলো একটি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে চায়।”
উপরে ডাক পড়িল। খুড়া গিয়া কহিলেন, “মা আপনার নাম কাশীতে বিখ্যাত। তাই আপনাকে দেখিয়া পুণ্যসঞ্চয় করিতে আসিলাম। আমার আর-কোনো কামনা নাই। আমার একটি দৌহিত্রীর অসুখ, আপনার ছেলেকে ডাকিতে আসিয়াছিলাম, তিনি বাড়ি নাই ; তাই মনে করিলাম শুধু-শুধু ফিরিব না, একবার আপনাকে দর্শন করিয়া যাইব।”
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “নলিন এখনি আসিবে, আপনি ততক্ষণ একটু বসুন। বেলা নিতান্ত কম হয় নাই, আপনার জন্য কিছু জলখাবার আনাইয়া দিই।”
খুড়া কহিলেন, “আমি জানিতাম, আপনি আমাকে না খাওয়াইয়া ছাড়িবেন না— আমার যে ভোজনে বেশ— একটুখানি শখ