‘হেন’ শব্দটা রয়ে গেছে ভাষার মহদাশ্রয় পদ্যে। কিন্তু ‘সে’ কিংবা ‘এ’ শব্দের যোগে এখনো চলে, যেমন : সে-হেন লোক। এই ‘হেন’ শব্দের যো ‘সে’ শব্দে অক্ষমতা বা অসম্মানের আভাস দেয়। যেমন : সে-হেন লোক দৌড় মারলে। ‘হেন’ শব্দের যোগে ‘এ’ শব্দে অসামান্যতা বোঝায়, যেমন : এ-হেন লোক দেখা যায় না, এ-হেন দুর্দশাতেও মানুষ পড়ে।
‘কেন’র সঙ্গে ‘যে’ যোগ করলে পরিতাপ বা ভর্ৎসনার ভঙ্গী আসে, যেমন : কেন যে মরতে আসা, কেন যে এতগুলো পাস করলে। ‘কী করতে’ শব্দটারও ঐ-রকম ঝোঁক, অর্থাৎ তাতে আছে ব্যর্থতার ক্ষোভ।
শুধু ‘কী’ শব্দের মধ্যেও এই রকমের ভঙ্গী। এই কাজে ওর সঙ্গে যোগ দেয় ই অব্যয় : কী চেহারাই করেছ, কী কবিতাই লিখেছেন, কী সাধুগিরিই শিখেছ। ঐ ‘কী’ এর সঙ্গে ‘বা’ যোগ করলে ঝাঁজ আরও বাড়ে। ‘কী বা’কে বাঁকিয়ে ‘কীবে’ করলে ভঙ্গীতে আরও বিদ্রূপ পৌঁছয়। ই’র সহযোগিতা বাদ দিলে ‘কী’ বিশুদ্ধ বিস্ময় প্রকাশের কাজে লাগে : কী সুন্দর তার মুখ।
সম্মান খর্ব করবার বিশেষ প্রত্যয় বাংলা ভাষায় যথেষ্ট পাওয়া গেল, সর্বনামের প্রয়োগেও বক্রোক্তি দেখা গেছে। কিন্তু শ্রদ্ধা বা প্রশংসা-প্রকাশের প্রয়োজনে ভাষায় কেবল একটা বিশেষ ভঙ্গী আছে ‘আহা’ অব্যয় শব্দটার যোগে, যেমন : আহা মানুষটি বড়ো ভালো। করুণা প্রকাশেও এর ব্যবহার আছে। অথচ ‘আহামরি’ শব্দের পরিণামটা ভালো হয় নি। গোড়ায় এর উদ্দেশ্য ভালোই ছিল, এখন এ শব্দটার যে প্রকৃত স্বভাব সেইটাই গেছে বিপরীত হয়ে। এটা হয়েছে বিদ্রূপের বাহন। ওটাকে আরও একটু প্রশস্ত করে হল ‘আহা ম’রে যাই’; এর ঝাঁজ আরও বেশি। পদে পদে বাংলায় এই বাঁকা ভঙ্গীটা এসে পড়ে : ভা-রি তো পণ্ডিত, ম-স্ত নবাব। এদের কণ্ঠস্বর উৎসাহে দীর্ঘকৃত হয়ে গাল পাড়ে যথার্থ মানেটাকে ডিঙিয়ে। হাঁদারাম ভোঁদারাম বোকারাম ভ্যাবাগঙ্গারাম শব্দগুলোর ব্যবহার চূড়ান্ত মূঢ়তা প্রকাশের জন্যে। কিন্তু ‘সুবুদ্ধিরাম’ ‘সুপটুরাম’ বলবার প্রয়োজনমাত্র ভাষা অনুভব করে না। সবচেয়ে অদ্ভুত এই যে ‘রাম’ শব্দের সঙ্গেই যত বোকা বিশেষণের যোগ, ‘বোকা লক্ষ্মণ’ বলতে কারও রুচিই হয় না।
‘কি’ যেখানে অব্যয় সেখানে প্রশ্নের সংকেত। ঊহ্য বিশেষ্যের সহযোগে বিশেষণে ওর প্রয়োগ আছে। তুমি কী করছ : অর্থাৎ ‘কী কাজ’ করছ। আর-একটা প্রয়োগ বিস্ময় বোঝাতে, যেমন : কী সুন্দর। পূর্বেই বলেছি তীক্ষ্মধার স্বরবর্ণ ই সঙ্গে না থাকলে এর সৌজন্য বজায় থাকে। বিশেষণ-প্রয়োগে ‘কী’, যথা : কী কাজে লাগবে জানি নে। ‘কী’ বিশেষণ শব্দে অচেতন বা নির্বস্তুক বা অনির্দিষ্ট বোঝায় : ওর কী দশা হবে, কী হতে কী হল। বিকল্প বোঝাতে ওর প্রয়োগ আছে, যেমন : কী রাম কী শ্যাম কাউকেই বাদ দেওয়া যায় না। ‘কোন্’ বিশেষণ জড় চেতন দুইয়েই লাগে। সর্বনামের কর্মকারকে সাধারণত কে বিভক্তি : আমাকে তোমাকে। ‘সে’র বেলায় ‘তাকে’ কিংবা ‘সেটিকে’ ‘সেটাকে’।
বাংলা সর্বনাম করণকারকে একটা বিভক্তির উপরে আর-একটি চিহ্ন জোড়া হয়। বিভক্তিটা সম্বন্ধপদের, যেমন ‘আমার’, ওতে জোড়া হয় ‘দ্বারা’ শব্দ : আমার দ্বারা। আর-একটা শব্দচিহ্ন আছে ‘দিয়ে’। তার বেলায় মূলশব্দে লাগে কর্মকারকের বিভক্তি : আমাকে দিয়ে।
‘কী’ শব্দের করণকারকের রূপ : কিসে, কিসে করে, কী দিয়ে, কিসের দ্বারা। অধিকরণণেরও রূপ ‘কিসে’, যথা : এ লেখাটা কিসে আছে। এ-সমস্তই একবচনের ও অজীববাচকের দৃষ্টান্ত, এরা বহুবচনে হবে : এগুলোকে দিয়ে, সেগুলোকে দিয়ে, কোন্গুলোকে দিয়ে। অসম্মানে মানুষের বেলা হয়, নচেৎ হয় : এদের দিয়ে, তাদের দিয়ে, ওদের দিয়ে।
সাধারণত বাংলায় বিশেষণপদের বহুবচনরূপ নেই। ওদের অধিকৃত বিশেষ্য শব্দগুলিতে বহুবচনের ব্যবস্থা করতে হয়, যথা : বুনো পশুদের, পিতলের ঘটিগুলোর। বলা বাহুল্য ‘ঘটিদের’ হয় না, ‘পশুদের’ হয়। রা এবং দের বিভক্তি জড়বাচক শব্দের অধিকারে নেই। তার পক্ষে গুলো শব্দই বৈধ। অথচ গুলো অপর পক্ষের ব্যবহারেও লাগে। কিন্তু পরিমাণবাচক ‘এত’ ‘তত’ ‘যত’ ‘কত’