বাংলা বিশেষ্যপদে বহুবচনের প্রভাব অল্পই। অধিকাংশ স্থলেই ‘সব’ ‘গুলি’ ‘সকল’ প্রভৃতি শব্দ জোড়া দিয়ে কাজ চালানো হয়। এ ভাষায় সর্বনাম শব্দে বহুবচনের বিভক্তি যতটা চলে অন্যত্র ততটা নয়। বহুবচনে ‘মানুষরা’ বলে থাকি অথচ ‘ঘোড়ারা’ বলতে কানে ঠেকে, অথচ ‘ঘোড়াদের’ বলা চলে। মোটের উপর এ কথা খাটে যে সচেতন জীবদের নিয়ে বহুবচনে রা এবং সম্বন্ধে ও কর্মকারকে দের চিহ্ন ব্যবহার হয়ে থাকে। ‘মোষেরা খুব বলবান জীব’ বা ‘ময়ূরদের পুচ্ছ লম্বা’ এটা নিয়মবিরুদ্ধ নয়। এই রা চিহ্ন সাধারণ বিশেষ্যে লাগে। বিশেষ বিশেষ্যে ওর প্রয়োগ কানে বাধে। বলতে পারি ‘ঐ মোষরা পাঁকে ডুবে আছে’, কিন্তু ‘ঐ মোষগুলো পাঁকে ডুবে আছে’ বললেই মানানসই হয়। ‘মোষরা’ বললে মোষজাতিকে মনে আসে, ‘মোষগুলো’ বললে মনে আসে বিশেষ মোষের দল।
‘মানুষরা নিষ্ঠুরতায় পশুকে হার মানালো’ ঠিক শোনায়, এও ঠিক শোনায় : কুলিগুলো নির্দয়ভাবে গাড়িতে বোঝা চাপিয়েছে। কিন্তু ‘মানুষগুলো পশুকে হার মানায়’ অশুদ্ধ। সাধারণ বিশেষ্যে রা চলে কিন্তু বিশেষ বিশেষ্যে গুলো। ‘মানুষরা ওখানে জটলা করছে’ বললে মনে হয় যেন জানানো হচ্ছে অন্য কোনো জীব করে নি। এখানে ‘মানুষগুলো’ বললেই সংশয় থাকে না।
‘টেবিলরা’ ‘চৌকিরা’ নিষিদ্ধ। জড়পদার্থের ‘গুলো’ ছাড়া গতি নেই। আর-একটা শব্দ আছে, কথার পূর্বে বসে সমষ্টি বোঝায়, যেমন ‘সব’ : সব চৌকি, সব জন্তু, সব মানুষ। কিন্তু এখানে এই শব্দ কেবলমাত্র বহুবচন বোঝায় না, সঙ্গে সঙ্গে একটা ঝোঁক দেয়। সব চৌকি সরিয়ে দাও, অর্থাৎ একটাও বাকি রেখো না। সব ভিখিরিই বাঙালি, অর্থাৎ নির্বশেষে বাঙালি। ‘সব’ প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে ‘গুলো’ প্রয়োগটা যোগ দিতে চায়, যেমন : সব চৌকিগুলোই ভাঙা, সব ভিখিরিগুলোই চেঁচাচ্ছে। এখানে ‘সব’ বোঝাচ্ছে একান্ততা, আর ‘গুলো’ বোঝাচ্ছে বহুবচন। বহুবচনে এক সময়ে ‘সব’ ব্যবহৃত হত। কবিতায় এখনো দেখা যায়, যেমন : পাখিসব তোমাসব ইত্যাদি। আমরা বলি : কাফ্রিরা সব কালো। বহুবচনের রা বিভক্তির সঙ্গে জোড়া লাগে ‘সব’ শব্দ : এরা সব গেল কোথায়। শুধু ‘এরা গেল কোথায়’ বললেই চলে, কিন্তু ‘সব’ শব্দের দ্বারা সমষ্টির উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এই ‘সব’ শব্দ একবচনকে বহুবচন করে না, বহুবচনকে সুনির্দিষ্ট করে। ‘সবাই’ শব্দে আরও বেশি জোর লাগে : এরা যে সবাই চলে গেছে, কিংবা, চৌধুরীদের সবাইকেই নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। ‘সব’ শব্দের সমার্থক হচ্ছে ‘সকল’ : এরা সকলেই চ’লে গেছে, কিংবা, চৌধুরীদের সকলকেই নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। কিন্তু ‘সকল’ শব্দের প্রয়োগ ‘সব’ শব্দের চেয়ে সংকীর্ণ।
এই প্রসঙ্গে আমাদের ভাষার একটা বিশেষ ভঙ্গীর কথা বলি। ‘সব’ শব্দের অর্থে কোনো দূষণীয়তা নেই, ‘যত’ সর্বনাম শব্দটাও নিরীহ। কিন্তু দুটোকে এক করলে সেই জুড়িশব্দটা হয়ে ওঠে নিন্দার বাহন। ‘মূর্খ’ ‘কুঁড়ে’ কিংবা ‘লক্ষ্মীছাড়া’ প্রভৃতি কটুস্বাদ বিশেষণ ঐ ‘যত সব’ শব্দটাকে বাহন করে ভাষার যেন মুখ সিট্কোতে আসে, যথা : যত সব বাঁদর, কিংবা কুঁড়ে, কিংবা লক্ষ্মীছাড়া। এখানে বলা উচিত ঐ ‘যত’ শব্দটার মধ্যেই আছে বিষ। ‘যত বাঁদর এক জায়গায় জুটেছে’ বললেই যথেষ্ট অকথ্য বলা হয়। লক্ষ্য করবার বিষয়টা এই যে, ‘যত’ শব্দটা একটা অসম্পূর্ণ সর্বনাম, ‘তত’ দিয়ে তবে এর সম্পূর্ণতা। ‘তত’ বাদ দিলে ‘যত’ হয়ে পড়ে বেকার, লেগে যায় অনর্থক গালমন্দর কাজে।
বাংলা ভাষায় সর্বনামের খুব ঘটা। নানা শ্রেণীর সর্বনাম, যথা ব্যক্তিবাচক, স্থানবাচক, কালবাচক, পরিমাণবাচক, তুলনাবাচক, প্রশ্নবাচক।
‘মুই’ এক কালে উত্তমপুরুষ সর্বনামের সাধারণ ব্যবহারে প্রচলিত ছিল, প্রাচীন কাব্যগ্রন্থে তা দেখতে পাই। ‘আমহি’ ক্রমশ