ক্ষেমংকরী চমকিয়া উঠিয়া কহিলেন, “বিবাহ হইয়া গেল— বল কী নলিন!”
নলিনাক্ষ। হাঁ, হইয়া গেল। বধূ লইয়া নৌকাতেই উঠিলাম। যেদিন বৈকালে উঠিলাম, সেইদিনই ঘণ্টা-দুয়েক বাদে সূর্যাস্তের এক দণ্ড পরে হঠাৎ সেই অকালে ফাল্গুন মাসে কোথা হইতে অত্যন্ত গরম একটা ঘূর্ণিবাতাস আসিয়া এক মুহূর্তে আমাদের নৌকা উলটাইয়া কী করিয়া দিল, কিছু যেন বোঝা গেল না।
ক্ষেমংকরী বলিলেন, “মধুসূদন!” তাঁহার সর্বশরীরে কাঁটা দিয়া উঠিল।
নলিনাক্ষ। ক্ষণকাল পরে যখন বুদ্ধি ফিরিয়া আসিল তখন দেখিলাম, আমি নদীতে এক জায়গায় সাঁতার দিতেছি, কিন্তু নিকটে কোনো নৌকা বা আরোহীর কোনো চিহ্ন নাই। পুলিসে খবর দিয়া খোঁজ অনেক করা হইয়াছিল, কিন্তু কোনো ফল হইল না।
ক্ষেমংকরী পাংশুবর্ণ মুখ করিয়া কহিলেন, “যাক, যা হইয়া গেছে তা গেছে, ও কথা আমার কাছে আর কখনো বলিস নে— মনে করিতেই আমার বুক কাঁপিয়া উঠিতেছে।”
নলিনাক্ষ। এ কথা আমি কোনোদিনই তোমার কাছে বলিতাম না, কিন্তু বিবাহের কথা লইয়া তুমি নিতান্তই জেদ করিতেছ বলিয়াই বলিতে হইল।
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “একবার একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়াছিল বলিয়া তুই ইহজীবনে কখনো বিবাহই করিবি না?”
নলিনাক্ষ কহিল, “সেজন্য নয় মা, যদি সে মেয়ে বাঁচিয়া থাকে?”
ক্ষেমংকরী। পাগল হইয়াছিস? বাঁচিয়া থাকিলে তোকে খবর দিত না?
নলিনাক্ষ। আমার খবর সে কী জানে? আমার চেয়ে অপরিচিত তাহার কাছে কে আছে? বোধ হয় সে আমার মুখও দেখে নাই। কাশীতে আসিয়া তারিণী চাটুজ্জেকে আমার ঠিকানা জানাইয়াছি; তিনিও কমলার কোনো খোঁজ পান নাই বলিয়া আমাকে চিঠি লিখিয়াছেন।
ক্ষেমংকরী। তবে আবার কী।
নলিনাক্ষ। আমি মনে মনে ঠিক করিয়াছি, পুরা একটি বৎসর অপেক্ষা করিয়া তবে তাহার মৃত্যু স্থির করিব।
ক্ষেমংকরী। তোমার সকল বিষয়েই বাড়াবাড়ি। আবার এক বৎসর অপেক্ষা করা কিসের জন্য?
নলিনাক্ষ। মা, এক বৎসরের আর দেরিই বা কিসের। এখন অঘ্রাণ; পৌষে বিবাহ হইতে পারিবে না; তাহার পরে মাঘটা কাটাইয়া ফাল্গুন।
ক্ষেমংকরী। আচ্ছা, বেশ। কিন্তু পাত্রী ঠিক রহিল। হেমনলিনীর বাপকে আমি কথা দিয়াছি।