এ কথা আর অস্বীকার করা চলে না যে বাংলা সাহিত্যের ভাষা কলকাতার চলিত ভাষাকে আশ্রয় করেছে। শিশুকাল হতে বাংলার সকল প্রদেশের লোকেরই এই ভাষা শিক্ষা করা আবশ্যক। নইলে সাহিত্যে ব্যবহারের সময় বাধা পেতে হবে।
য়ুরোপের সকল দেশেই প্রদেশভেদে উপভাষা প্রচলিত আছে কিন্তু তৎসত্ত্বেও সে-সকল দেশে ভদ্রসাধারণের কথিত ভাষায় প্রভেদ নেই। এবং সেই ভদ্রসমাজের কথিত ভাষার সঙ্গে সে-সকল দেশের সাহিত্যের ভাষা মোটের উপর অভিন্ন। আমাদের দেশেও ভাষার মধ্যে যথাসম্ভব এইরকম মিল প্রার্থনীয়। বাংলা ভাষা স্বভাবতই দ্রুতবেগে এই মিলের দিকে চলেচে।
কলকাতার কথিত ভাষার মধ্যেও সম্পূর্ণ ঐক্য নেই। লণ্ডনেও ভাষার একটা নিম্নস্বর আছে তাকে বলে কক্নি। সেটা সাহিত্যভাষা থেকে দূরবর্তী।
আমাদের চলিত ভাষামূলক আধুনিক সাহিত্য ভাষার আদর্শ এখনো পাকা হয় নি বলে লেখকদের রুচি ও অভ্যাস-ভেদবশত শব্দব্যবহার সম্বন্ধে যথেচ্ছাচার আছে। আরো কিছুকাল পরে তবে এর নির্মাণকার্য সমাধা হবে।
তবু আপাতত আমি নিজের মনে একটা নিয়ম অনুসরণ করি। আমার কানে যেটা অপভাষা বলে ঠেকে সেটাকে আমি বর্জন করি। “ভিতর” এবং “ভেতর” “উপর” এবং “ওপর” “ঘুমতে” এবং “ঘুমুতে” এই দুইরকমেরই ব্যবহার কলকাতায় আছে কিন্তু শেষোক্তগুলিকে আমি অপভাষা বলি। “দুয়োর” কথার জায়গায় “দোর” কথা ব্যবহার করতে আমার কলমে ঠেকে। কলকাতার “ভাইয়ের বিয়ে” না বলে কেউ কেউ “ভেয়ের বে” কিংবা “করলুম”-এর জায়গায় “কন্নু” বলে, কিন্তু এগুলিকে সাহিত্যে স্বীকার করতে পারি নে। গুছুতে, রেতের বেলা প্রভৃতি ব্যবহার আজকাল দেখি, কিন্তু এগুলিকে স্বীকার করে নিতে পারি নে।
প্রণামের শ্রেণীভেদ আছে। ১ নম্বর সহজ প্রণাম হচ্চে গ্রীবা বাঁকিয়ে জোড় হাত কপালে ঠেকানো। যখন বলি গড় করি তোমার পায়ে তখন বোঝায় এমন কোনো ভঙ্গি করা যেটা বিনম্রতার চূড়ান্ত। গড় শব্দে একটা বিশেষ নম্রতার ভঙ্গি বোঝায় তার প্রমাণ তার সঙ্গে ‘করা’ ক্রিয়াপদের যোগ। সেইরকম ভঙ্গি করে প্রণাম করাই গড় করে প্রণাম করা। নমস্কার হই বলি নে, নমস্কার করি বলি—গড় করি সেই পর্যায়ের শব্দ। গড়াই গড়াগড়ি দিই শব্দে বুঝতে হবে শরীরকে একটা বিশেষ অবস্থাপন্ন করি, এর সংসর্গে ‘হই’ ক্রিয়াপদ আসতেই পারে না। বস্তুত গড় করে প্রণাম করা হচ্চে পায়ের কাছে গড়িয়ে প্রণাম করা। এই প্রণামে সেই ভঙ্গিটা কৃত হয়।১
১- গিরিশকুমার বসুকে লিখিত পত্র