যোগেন্দ্রের বাসায় আসিয়া রমেশ একটা চৌকিতে বসিল। যোগেন্দ্র কহিল, “না, বসা নয়। আমি জানি প্রাতঃস্নান নামে তোমার একটা ঘোরতর কুসংস্কার আছে, সেটা সারিয়া এসো। ইতিমধ্যে আর-এক বার গরম জলের কাৎলিটা আগুনে চড়াইয়া দিই। আতিথ্যের দোহাই দিয়া আজ দ্বিতীয় বার চা খাইয়া লইব।”
এইরূপে আহার আলাপ ও বিশ্রামে দিন কাটিয়া গেল। রমেশ যে বিশেষ কথাটা বলিবার জন্য এখানে আসিয়াছিল যোগেন্দ্র সমস্ত দিন তাহা কোনোমতেই বলিবার অবকাশ দিল না। সন্ধ্যার পর আহারান্তে কেরোসিনের আলোকে দুই জনে দুই কেদারা টানিয়া লইয়া বসিল। অদূরে শৃগাল ডাকিয়া গেল ও বাহিরে অন্ধকার রাত্রি ঝিল্লির শব্দে স্পন্দিত হইতে লাগিল।
রমেশ কহিল, “যোগেন, তুমি তো জানই, তোমাকে কী কথা বলিতে আমি এখানে আসিয়াছি। একদিন তুমি আমাকে যে প্রশ্ন করিয়াছিলে সে প্রশ্নের উত্তর করিবার সময় তখন উপস্থিত হয় নাই। আজ আর উত্তর দিবার কোনো বাধা নাই।”
এই বলিয়া রমেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। তাহার পরে ধীরে ধীরে সে আগাগোড়া সমস্ত ঘটনা বলিয়া গেল। মাঝে মাঝে তাহার স্বর রুদ্ধ হইয়া কণ্ঠ কম্পিত হইল, মাঝে মাঝে কোনো কোনো জায়গায় সে দুই-এক মিনিট চুপ করিয়া রহিল। যোগেন্দ্র কোনো কথা না বলিয়া স্থির হইয়া শুনিল।
যখন বলা হইয়া গেল তখন যোগেন্দ্র একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, “এই-সকল কথা যদি সেদিন বলিতে, আমি বিশ্বাস করিতে পারিতাম না।”
রমেশ। বিশ্বাস করার হেতু তখনো যেটুকু ছিল, এখনো তাহাই আছে। সেজন্য তোমার কাছে আমার এই প্রার্থনা যে, আমি যে গ্রামে বিবাহ করিয়াছিলাম সে গ্রামে একবার তোমাকে যাইতে হইবে। তাহার পর সেখান হইতে কমলার মাতুলালয়েও লইয়া যাইব।
যোগেন্দ্র। আমি কোনোখানে এক পা নড়িব না, আমি এই কেদারাটার উপরে অটল হইয়া বসিয়া তোমার কথার প্রত্যেক অক্ষর বিশ্বাস করিব। তোমার সকল কথাই বিশ্বাস করা আমার চিরকালের অভ্যাস; জীবনে একবারমাত্র তাহার ব্যত্যয় হইয়াছে, সেজন্য আমি তোমার কাছে মাপ চাই।
এই বলিয়া যোগেন্দ্র চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া রমেশের সম্মুখে আসিল; রমেশ উঠিয়া দাঁড়াইতেই দুই বাল্যবন্ধু একবার পরস্পর কোলাকুলি করিল। রমেশ রুদ্ধ কণ্ঠ পরিষ্কার করিয়া লইয়া কহিল, “আমি কোথা হইতে ভাগ্যরচিত এমন একটা দুশ্ছেদ্য মিথ্যার জালে জড়াইয়া পড়িয়াছিলাম যে, তাহার মধ্যেই সম্পূর্ণ ধরা দেওয়া ছাড়া আমি কোনো দিকেই কোনো উপায় দেখিতে পাই নাই। আজ যে আমি তাহা হইতে মুক্ত হইয়াছি, আর যে আমার কাহারও কাছে কিছুই গোপন করিবার নাই, ইহাতে আমি প্রাণ পাইয়াছি। কমলা কী জানিয়া, কী ভাবিয়া আত্মহত্যা করিল, তাহা আমি আজ পর্যন্ত বুঝিতে পারি নাই, আর বুঝিবার কোনো সম্ভাবনাও নাই— কিন্তু ইহা নিশ্চয়, মৃত্যু যদি এমন করিয়া আমাদের দুই জীবনের এই কঠিন গ্রন্থি কাটিয়া না দিত, তবে শেষকালে আমরা