আর মরিব কেন! তুমি এমনি কি হিসাব জানো যে, একবারে ঠিক দিয়া রাখিয়াছ যে আমরা মরিতেই বসিয়াছি। তোমার বুড়োমানুষের হিসাব অনুযায়ী মনুষ্যসমাজ চলে না। তুমি কি জানো, মানুষ সহসা কোথা হইতে বল পায়, কোথা হইতে দৈবশক্তি লাভ করে? মনুষ্যসমাজ সাধারণত হিসাবে চলে বটে, কিন্তু এক-এক সময়ে সেখানে যেন ভেলকি লাগিয়া যায়, তখন আর হিসাবে মেলে না। অন্য সময়ে দুয়ে দুয়ে চার হয়, সহসা একদিন দুয়ে দুয়ে পাঁচ হইয়া যায়, তখন বুড়োমানুষেরা চক্ষু হইতে চশমা খুলিয়া অবাক্ হইয়া চাহিয়া থাকে। সহসা যখন নূতন ভাবের প্রবাহ উপস্থিত হইয়া জাতির হৃদয়ে আবর্ত রচনা করে তখনই সেই ভেলকি লাগিবার সময়–তখন যে কী হইতে কী হয় ঠাহর পাইবার জো নাই। অতএব আমবাগানে আমাদের সেই ক্ষুদ্র নীড়ের মধ্যে আর ফিরিব না।
হয় মরিব নয় বাঁচিব, এই কথাই ভালো। মরিবার ভয়ে বাঁচিয়া থাকিবার দরকার নাই। ক্রম্ওয়েল যখন প্রজাদলের দাসত্বরজ্জু ছেদন করিতেছিলেন তখন তিনি মরিতেও পারিতেন, বাঁচিতেও পারিতেন। ওয়াশিংটন যখন নূতন জাতির স্বাতন্ত্র্যের ধ্বজা উঠাইয়াছিলেন তখন তিনি মরিতেও পারিতেন, বাঁচিতেও পারিতেন। পৃথিবীর সর্বত্রই এমন কেহ মরে কেহ বাঁচে–তাহাতে আপত্তি কী। নিরুদ্যমই প্রকৃত মৃত্যু। আমরা হয় বাঁচিব নাহয় মরিব–তাই বলিয়া কাজকর্ম ছাড়িয়া দিয়া দাদামশায়ের কোলের কাছে বসিয়া সমস্ত দিন উপকথা শুনিতে পারিব না। তোমার কি ভয় হয় পাছে তোমার বংশে বাতি দেবার কেহ না থাকে? জিজ্ঞাসা করি, এখনই বা কে বাতি দিতেছে? সমস্তই যে অন্ধকার।
বিদায় লইলাম দাদামহাশয়! আমাদের আর চিঠিপত্র চলিবে না। আমাদের কাজ করিবার বয়স। সংসারে কাজের বাধা যথেষ্ট আছে–পদে পদে বিঘ্নবিপত্তি, তাহার পরে বুড়োমানুষদের কাছ হইতে যদি নৈরাশ্য সঞ্চয় করিতে হয় তাহা হইলে যৌবন ফুরাইবার আগেই বৃদ্ধ হইতে হইবে। তাহা হইলে পঞ্চাশে পৌঁছিবার পূর্বেই অরণ্যাশ্রম গ্রহণ করিতে হইবে। সম্মুখে আমাকে আহ্বান করিতেছে, আমি তোমার দিকে ফিরিয়া চাহিব না। তুমি বলিতেছ পথের মধ্যে খানা আছে, ডোবা আছে, সেইখানে পড়িয়া তুমি ঘাড় ভাঙিয়া মরিবে, অতএব ঘরের দাওয়ায় মাদুর পাতিয়া বসিয়া থাকাই ভালো–আমি তোমার কথায় বিশ্বাস করি না। আমি দুর্বল সত্য, কিন্তু তোমার উপদেশে আমি তো বল পাইতেছি না। আমার ব্রতপালনের পক্ষে আমি হীনবুদ্ধি বটে, কিন্তু তোমার উপদেশে আমি তো বুদ্ধি পাইতেছি না। অতএব আমার যেটুকু বল, যেটুকু বুদ্ধি আছে তাহাই সহায় করিয়া চলিলাম–মরিতে হয় তো চিরজীবনসমুদ্রে ঝাঁপ দিয়া মরিব।
সেবক
শ্রীনবীনকিশোর শর্মণঃ