বস্তুত, আজ যে পোলিটিকাল প্রসঙ্গ লইয়া এ সভায় উপস্থিত হইয়াছি সেটা হয়তো সম্পূর্ণ ফাঁকা আওয়াজ, কিন্তু কাল আবার আর-একটা কিছু মারাত্মক ব্যাপার উঠিয়া পড়া আশ্চর্য নহে। ঘড়ি-ঘড়ি এমন কতবার ছুটাছুটি করিতে হইবে? আজ যাঁহার দ্বারে মাথা খুঁড়িয়া মরিলাম তিনি সাড়া দিলেন না—অপেক্ষা করিয়া বসিয়া রহিলাম, ইঁহার মেয়াদ ফুরাইলে যিনি আসিবেন তাঁহার যদি দয়ামায়া থাকে। তিনি যদি বা দয়া করেন তবু আশ্বস্ত হইবার জো নাই, আর-এক ব্যক্তি আসিয়া দয়ালুর দান কানে ধরিয়া আদায় করিয়া তাহার হাল-নাগাদ সুদসুদ্ধ কাটিয়া লইতে পারেন। এতবড়ো অনিশ্চয়ের উপরে আমাদের সমস্ত আশাভরসা স্থাপন করা যায়?
প্রাকৃতিক নিয়মের উপরে ক্ষোভ চলে না। ‘সনাতন ধর্মশাস্ত্রমতে আমার পাখা পোড়ানো উচিত নয়’ বলিয়া পতঙ্গ যদি আগুনে ঝাঁপ দিয়া পড়ে, তবু তাহার পাখা পুড়িবে। সে স্থলে ধর্মের কথা আওড়াইয়া সময় নষ্ট না করিয়া আগুনকে দূর হইতে নমস্কার করাই তাহার কর্তব্য হইবে। ইংরেজ আমাদিগকে শাসন করিবে, আমাদিগকে সম্পূর্ণ আয়ত্ত করিয়া রাখিতে ইচ্ছা করিবে, যেখানে তাহার শাসনসন্ধি শিথিল হইবার লেশমাত্র আশঙ্কা করিবে, সেইখানেই তৎক্ষণাৎ বলপূর্বক দুটো পেরেক ঠুকিয়া দিবে, ইহা নিতান্তই স্বাভাবিক-পৃথিবীর সর্বত্রই এইরূপ হইয়া আসিতেছে—আমরা সূক্ষ্ম তর্ক করিতে এবং নিখুঁত ইংরেজি বলিতে পারি বলিয়াই যে ইহার অন্যথা হইবে, তা হইবে না। এরূপ স্থলে আর যাই হোক, রাগারাগি করা চলে না।
মানুষ প্রাকৃতিক নিয়মের উপরে উঠিতে পারে না যে তাহা নহে, কিন্তু সেটাকে প্রাত্যহিক হিসাবের মধ্যে আনিয়া ব্যবসা করা চলে না। হাতের কাছে একটা দৃষ্টান্ত মনে পড়িতেছে। সেদিন কাগজে পড়িয়াছিলাম, ডাক্তার চন্দ্র খ্রীস্টানমিশনে লাখখানেক টাকা দিবার ব্যবস্থা করিয়াছেন—আইনঘটিত ত্রুটি থাকাতে তাঁহার মৃত্যুর পরে মিশন সেই টাকা পাওয়ার অধিকার হারাইয়াছিল। কিন্তু ডাক্তার চন্দ্রের হিন্দুভ্রাতা আইনের বিরূপতাসত্ত্বেও তাঁহার ভ্রাতার অভিপ্রায় স্মরণ করিয়া এই লাখ টাকা মিশনের হস্তে অর্পণ করিয়াছেন। তিনি ভ্রাতৃসত্য রক্ষা করিয়াছেন। যদি না করিতেন, যদি বলিতেন, আমি হিন্দু হইয়া খ্রীস্টানধর্মের উন্নতির জন্য টাকা দিব কেন—আইনমতে যাহা আমার তাহা আমি ছাড়িব না। এ কথা বলিলে তাঁহাকে নিন্দা করিবার জো থাকিত না। কারণ, সাধারণত আইন বাঁচাইয়া চলিলেই সমাজ নীরব থাকে। কিন্তু আইনের উপরেও ধর্ম আছে, সেখানে সমাজের কোনো দাবি খাটে না। সেখানে যিনি যান, তিনি নিজের স্বাধীন মহত্ত্বের জোরে যান, মহতের গৌরবই তাই; তাঁহার ওজনে সাধারণকে পরিমাণ করা চলে না।
ইংরেজ যদি বলিত, জিত দেশের প্রতি বিদেশী বিজেতার যে-সকল সর্বসম্মত অধিকার আছে তাহা আমরা পরিত্যাগ করিব, কারণ, ইহারা বেশ ভালো বাগমীিদ—যদি বলিত, বিজিত পরদেশী সম্বন্ধে অল্পসংখ্যক বিজেতা স্বাভাবিক আশঙ্কাবশত যে-সকল সতর্কতার কঠোর ব্যবস্থা করে তাহা আমরা করিব না—যদি বলিত, আমাদের স্বদেশে স্বজাতির কাছে আমাদের গবর্মেন্ট সকল বিষয়ে যেরূপ খোলসা জবাবদিহি করিতে বাধ্য এখানেও সেরূপ সম্পূর্ণভাবে বাধ্যতা স্বীকার করিব, সেখানে সরকারের কোনো ভ্রম হইলে তাহাকে যেরূপ প্রকাশ্যে তাহা সংশোধন করিতে হয় এখানেও সেইরূপ করিতে হইবে, এ দেশ কোনো অংশেই আমাদের নহে, ইহা সম্পূর্ণই এদেশবাসীর, আমরা যেন কেবলমাত্র খবরদারি করিতে আসিয়াছি এমনিতরো নিরাসক্তভাবে কাজ করিয়া যাইব—তবে আমাদের মতো লোককে ধুলায় লুণ্ঠিত হইয়া বলিতে হইত, তোমরা অত্যন্ত মহৎ, আমরা তোমাদের তুলনায় এত অধম যে, এ দেশে যতকাল তোমাদের পদধূলি পড়িবে ততকাল আমরা ধন্য হইয়া থাকিব। অতএব তোমরা আমাদের হইয়া পাহারা দাও, আমরা নিদ্রা দিই; তোমরা আমাদের হইয়া মূলধন খাটাও এবং তাহার লাভটা আমাদের তহবিলে জমা হইতে থাক্; আমরা মুড়ি খাই তোমরা