Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://rabindra-rachanabali.nltr.org)


গ্রাম্যসাহিত্য,৭
গ্রাম্যসাহিত্য
জল ভরিয়া আসে।

এই-সকল কারণে হরগৌরীর সম্বন্ধীয় গ্রাম্যছড়াগুলি বাস্তব ভাবের। তাহা রচয়িতা ও শ্রোতৃবর্গের একান্ত নিজের কথা। সেই-সকল কাব্যে জামাতার নিন্দা, স্ত্রীপুরুষের কলহ ও গৃহস্থালীর বর্ণনা যাহা আছে তাহাতে রাজভাব বা দেবভাব কিছুই নাই; তাহাতে বাংলাদেশের গ্রাম্য কুটিরের প্রাত্যহিক দৈন্য ও ক্ষুদ্রতা সমস্তই প্রতিবিম্বিত। তাহাতে কৈলাস ও হিমালয় আমাদের পানা-পুকুরের ঘাটের সম্মুখে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, এবং তাহাদের শিখররাজি আমাদের আম-বাগানের মাথা ছাড়াইয়া উঠিতে পারে নাই। যদি তাঁহারা নিজ নিজ অভ্রভেদী মূর্তি ধারণ করিবার চেষ্টামাত্র করিতেন তাহা হইলে বাংলার গ্রামের মধ্যে তাঁহাদের স্থান হইত না।

শরৎকালে রানী বলে বিনয়বচন
আর শুনেছ, গিরিরাজ, নিশার স্বপন?

এই স্বপ্ন হইতে কথা-আরম্ভ। সমস্ত আগমনী গানের এই ভূমিকা। প্রতিবৎসর শরৎকালে ভোরের বাতাস যখন শিশিরসিক্ত এবং রৌদ্রের রঙ কাঁচা সোনার মতো হইয়া আসে, তখন গিরিরানী সহসা একদিন তাঁহার শ্মশানবাসিনী সোনার গৌরীকে স্বপ্ন দেখেন, আর বলেন : আর শুনেছ গিরিরাজ নিশার স্বপন? এ স্বপ্ন গিরিরাজ আমাদের পিতামহ এবং প্রপিতামহদের সময় হইতে ললিত বিভাস এবং রামকেলি রাগিনীতে শুনিয়া আসিতেছেন, কিন্তু প্রত্যেক বৎসরই তিনি নূতন করিয়া শোনেন। ইতিবৃত্তের কোন্‌ বৎসরে জানি না, হরগৌরীর বিবাহের পরে প্রথম যে শরতে মেনকারানী স্বপ্ন দেখিয়া প্রত্যুষে জাগিয়া উঠিয়াছিলেন সেই প্রথম শরৎ সেই তাহার প্রথম স্বপ্ন লইয়াই বর্ষে বর্ষে ফিরিয়া আসে। জলে স্থলে আকাশে একটি বৃহৎ বেদনা বাজিয় উঠে, যাহাকে পরের হাতে দিয়াছি আমার সেই আপনার ধন কোথায়!

বৎসর গত হয়েছে কত, করছে শিবের ঘর।
যাও গিরিরাজ আনতে গৌরী কৈলাসশিখর॥

বলা বাহুল্য, গিরিরাজ নিতান্ত লঘু লোকটা নহেন। চলিতে ফিরিতে, এমন-কি, শোক-দুঃখ-চিন্তা অনুভব করিতে, তাঁহার স্বভাবতই কিঞ্চিৎ বিলম্ব ঘটিয়া থাকে। তাঁহার সেই সর্বাঙ্গীণ জড়তা ও ঔদাসীন্যের জন্য একবার গৃহিণীর নিকট গোটাকয়েক তীব্র তিরস্কার-বাক্য শুনিয়া তবে তিনি অঙ্কুশাহত হস্তীর ন্যায় গাত্রোত্থান করিলেন।

শুনে কথা গিরিরাজা লজ্জায় কাতর
পঞ্চমীতে যাত্রা করে শাস্ত্রের বিচার॥
তা শুনি মেনকারানী শীঘ্রগতি ধরি
খাজা মণ্ডা মনোহরা দিলেন ভাণ্ড ভরি॥
মিশ্রিসাঁচ চিনির ফেনি ক্ষীর তক্তি সরে
চিনির ফেনা এলাচদানা মুক্তা থরে থরে॥
ভাঙের লাড়ু সিদ্ধি ব’লে পঞ্চমুখে দিলেন
ভাণ্ড ভরি গিরিরাজ তখনি সে নিলেন॥

কিন্তু দৌত্যকার্যে যেরূপ নিপুণতা থাকা আবশ্যক হিমালয়ের নিকট তাহা প্রত্যাশা করা যায় না। কৈলাসে কন্যার সহিত অনর্থক বচসা করিয়া তাঁহার বিপুল স্থূল প্রকৃতির পরিচয় দিলেন। দোষের মধ্যে অভিমানিনী তাঁকে বলিয়াছিলেন–