হেমনলিনী স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। যোগেন্দ্র অধৈর্য সংবরণ করিতে না পারিয়া বলিয়া উঠিল, “হেম, তোমরা কল্পনাদ্বারা ছোটো কথাকে বড়ো করিয়া তুলিতে ভালোবাস। তোমার বিবাহ সম্বন্ধে যেমন গোলমাল ঘটিয়াছে এমন কত মেয়ের ঘটিয়া থাকে, আবার চুকিয়া-বুকিয়া পরিষ্কার হইয়া যায়; নহিলে ঘরের মধ্যে কথায় কথায় নভেল তৈরি হইতে থাকিলে তো লোকের প্রাণ বাঁচে না। ‘চিরজীবন সন্ন্যাসিনী হইয়া ছাদে বসিয়া আকাশের দিকে তাকাইয়া থাকিব।’ ‘সেই অপদার্থ মিথ্যাচারীটার স্মৃতি হৃদয়মন্দিরে স্থাপন করিয়া পূজা করিব’— পৃথিবীর লোকের সামনে এই-সমস্ত কাব্য করিতে তোমার লজ্জা করিবে না, কিন্তু আমরা যে লজ্জায় মরিয়া যাই। ভদ্র গৃহস্থঘরে বিবাহ করিয়া এই-সমস্ত লক্ষ্মীছাড়া কাব্য যত শীঘ্র পার চুকাইয়া ফেলো।”
লোকের চোখের সামনে কাব্য হইয়া উঠিবার লজ্জা যে কতখানি তাহা হেমনলিনী বিলক্ষণ জানে, এইজন্য যোগেন্দ্রের বিদ্রূপবাক্য তাহাকে ছুরির মতো বিঁধিল। সে কহিল, “দাদা, আমি কি বলিতেছি সন্ন্যাসিনী হইয়া থাকিব, বিবাহ করিব না?”
যোগেন্দ্র কহিল, “তাহা যদি না বলিতে চাও তো বিবাহ করো। অবশ্য, তুমি যদি বল স্বর্গরাজ্যের ইন্দ্রদেবকে না হইলে তোমার পছন্দ হইবে না, তাহা হইলে সেই সন্ন্যাসিনীব্রতই গ্রহণ করিতে হয়। পৃথিবীতে মনের মতো কটা জিনিসই বা মেলে, যাহা পাওয়া যায় মনকে তাহারই মতো করিয়া লইতে হয়। আমি তো বলি ইহাতেই মানুষের যথার্থ মহত্ত্ব।”
হেমনলিনী মর্মাহত হইয়া কহিল, “দাদা, তুমি আমাকে এমন করিয়া খোঁটা দিয়া কথা বলিতেছ কেন? আমি কি তোমাকে পছন্দ লইয়া কোনো কথা বলিয়াছি?”
যোগেন্দ্র। বল নাই বটে, কিন্তু আমি দেখিয়াছি, অকারণে এবং অন্যায় কারণে তোমার কোনো কোনো হিতৈষী বন্ধুর উপরে তুমি স্পষ্ট বিদ্বেষ প্রকাশ করিতে কুণ্ঠিত হও না। কিন্তু এ কথা তোমাকে স্বীকার করিতেই হইবে, এ জীবনে যত লোকের সঙ্গে তোমার আলাপ হইয়াছে তাহাদের মধ্যে একজন লোককে দেখা গেছে যে ব্যক্তি সুখে-দুঃখে মানে-অপমানে তোমার প্রতি হৃদয় স্থির রাখিয়াছে। এই কারণে আমি তাহাকে মনে মনে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি। তোমাকে সুখী করিবার জন্য জীবন দিতে পারে এমন স্বামী যদি চাও, তবে সে লোককে খুঁজিতে হইবে না। আর যদি কাব্য করিতে চাও তবে—
হেমনলিনী উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “এমন করিয়া তুমি আমাকে বলিয়ো না। বাবা আমাকে যেরূপ আদেশ করিবেন, যাহাকে বিবাহ করিতে বলিবেন, আমি পালন করিব। যদি না করি, তখন তোমার কাব্যের কথা তুলিয়ো।”
যোগেন্দ্র তৎক্ষণাৎ নরম হইয়া কহিল, “হেম, রাগ করিয়ো না বোন। আমার মন খারাপ হইয়া গেলে মাথার ঠিক থাকে না জান তো— তখন যাহা মুখে আসে তাহাই বলিয়া বসি। আমি কি ছেলেবেলা হইতে তোমাকে দেখি নাই, আমি কি জানি না লজ্জা তোমার পক্ষে কত স্বাভাবিক এবং বাবাকে তুমি কত ভালোবাস।”
এই বলিয়া যোগেন্দ্র অন্নদাবাবুর ঘরে চলিয়া গেল। যোগেন্দ্র তাহার বোনের উপর না জানি কিরূপ উৎপীড়ন করিতেছে, তাহাই কল্পনা করিয়া অন্নদা তাঁহার ঘরে উদ্বিগ্ন হইয়া বসিয়া ছিলেন; ভাইবোনের কথোপকথনের মাঝখানে গিয়া পড়িবার জন্য উঠি-উঠি করিতেছিলেন, এমন সময় যোগেন্দ্র আসিয়া উপস্থিত হইল— অন্নদা তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
যোগেন্দ্র কহিল, “বাবা, হেম বিবাহ করিতে সম্মত হইয়াছে। তুমি মনে করিতেছ, আমি বুঝি খুব বেশি জেদ করিয়া তাহাকে রাজি করাইয়াছি— তাহা মোটেই নয়। এখন, তুমি তাহাকে একবার মুখ ফুটিয়া বলিলেই সে অক্ষয়কে বিবাহ করিতে আপত্তি করিবে না।”
অন্নদা কহিলেন, “আমাকে বলিতে হইবে?”
যোগেন্দ্র। তুমি না বলিলে সে কি নিজে আসিয়া বলিবে ‘আমি অক্ষয়কে বিবাহ করিব’? আচ্ছা, নিজের মুখে তোমার বলিতে