কমলার পড়া হইয়া গেল। উমেশ কহিল, “মা, অমন করিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলে যে! রাত হইয়া যাইতেছে।”
ঘর নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। কমলার মুখের দিকে চাহিয়া উমেশ ভীত হইয়া উঠিল। কহিল, “মা, আমার কথা শুনিতেছ মা? ঘরে চলো, রাত হইল।”
কিছুক্ষণ পরে খুড়ার চাকর আসিয়া কহিল, “মায়ীজি, গাড়ি অনেক ক্ষণ দাঁড়াইয়া আছে। চলো আমরা যাই।”
শৈলজা জিজ্ঞাসা করিল, “ভাই, আজ কি তোমার শরীর ভালো নাই? মাথা ধরিয়াছে?” কমলা কহিল, “না। খুড়ামশায়কে দেখিতেছি না কেন?”
শৈল কহিল, “ইস্কুলে বড়োদিনের ছুটি আছে, দিদিকে দেখিবার জন্য মা তাঁহাকে এলাহাবাদে পাঠাইয়া দিয়াছেন— কিছুদিন হইতে দিদির শরীর ভালো নাই।”
কমলা কহিল, “তিনি কবে ফিরিবেন?”
শৈল। তাঁর ফিরিতে অন্তত হপ্তা-খানেক দেরি হইবার কথা। তোমাদের বাংলা সাজানো লইয়া তুমি সমস্ত দিন বড়ো বেশি পরিশ্রম কর, আজ তোমাকে বড়ো খারাপ দেখা যাইতেছে। আজ সকাল সকাল খাইয়া শুইতে যাও।
শৈলকে কমলা যদি সকল কথা বলিতে পারিত তবে বাঁচিয়া যাইত, কিন্তু বলিবার কথা নয়। ‘যাহাকে এতকাল আমার স্বামী বলিয়া জানিতাম সে আমার স্বামী নয়’, এ কথা আর যাহাকে হউক, শৈলকে কোনোমতেই বলা যায় না।
কমলা শোবার ঘরে আসিয়া দ্বার বন্ধ করিয়া প্রদীপের আলোকে আর-একবার রমেশের সেই চিঠি লইয়া বসিল। চিঠি যাহাকে উদ্দেশ করিয়া লেখা হইতেছে তাহার নাম নাই, ঠিকানা নাই, কিন্তু সে যে স্ত্রীলোক, রমেশের সঙ্গে তাহার বিবাহের প্রস্তাব হইয়াছিল ও কমলাকে লইয়াই তাহার সঙ্গে সম্বন্ধ ভাঙিয়া গেছে, তাহা চিঠি হইতে স্পষ্টই বোঝা যায়। যাহাকে চিঠি লিখিতেছে, রমেশ যে তাহাকেই সমস্ত হৃদয় দিয়া ভালোবাসে এবং দৈবদুর্বিপাকে কোথা হইতে কমলা তাহার ঘাড়ের উপর আসিয়া পড়াতেই অনাথার প্রতি দয়া করিয়া এই ভালোবাসার বন্ধন সে অগত্যা চিরকালের মতো ছিন্ন করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে, এ কথাও চিঠিতে গোপন নাই।
সেই নদীর চরে রমেশের সহিত প্রথম মিলন হওয়া হইতে আরম্ভ করিয়া আর এই গাজিপুরে আসা পর্যন্ত সমস্ত স্মৃতি কমলা মনে মনে আবৃত্তি করিয়া লইল; যাহা অস্পষ্ট ছিল সমস্ত স্পষ্ট হইল।
রমেশ যখন বরাবর তাহাকে পরের স্ত্রী বলিয়া জানিতেছে এবং ভাবিয়া অস্থির হইতেছে যে তাহাকে লইয়া কী করিবে, তখন যে কমলা নিশ্চিন্তমনে তাহাকে স্বামী জানিয়া অসংকোচে তাহার সঙ্গে চিরস্থায়ী ঘরকন্নার সম্পর্ক পাতাইতে বসিতেছে, ইহার লজ্জা কমলাকে বার বার করিয়া তপ্তশেলে বিঁধিতে থাকিল। প্রতিদিনের বিচিত্র ঘটনা মনে পড়িয়া সে যেন মাটির সঙ্গে মিশিয়া যাইতে লাগিল। এ লজ্জা তাহার জীবনে একেবারে মাখা হইয়া গেছে, ইহা হইতে কিছুতেই আর তাহার উদ্ধার নাই।
রুদ্ধঘরের দরজা খুলিয়া ফেলিয়া কমলা খিড়কির বাগানে বাহির হইয়া পড়িল। অন্ধকার শীতের রাত্রি, কালো আকাশ কালো পাথরের মতো কন্কনে ঠাণ্ডা। কোথাও বাষ্পের লেশ নাই; তারাগুলি সুস্পষ্ট জ্বলিতেছে।
সম্মুখে খর্বাকার কলমের আমের বন অন্ধকার বাড়াইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। কমলা কোনোমতেই কিছুই ভাবিয়া পাইল না। সে