Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://rabindra-rachanabali.nltr.org)


অখণ্ডতা, ৫
অখণ্ডতা
যথাস্থানে বিন্যস্ত হইয়া যাইতেছে। গারিবল্ডি এমনি করিয়া ভাঙাচোরা ইটালিকে নূতন করিয়া প্রতিষ্ঠা করেন, ওয়াশিংটন অরণ্যপর্বতবিক্ষিপ্ত আমেরিকাকে আপনার চারি দিকে টানিয়া আনিয়া একটি সাম্রাজ্যরূপে গড়িয়া দিয়া যান।

এই সমস্ত কার্য এক-একটি যোগসাধন।

কবি যেমন কাব্য গঠন করেন, তানসেন যেমন তান-লয়-ছন্দে এক-একটি গান সৃষ্টি করিতেন, রমণী তেমনি আপনার জীবনটি রচনা করিয়া তোলে। তেমনি অচেতনভাবে, তেমনি মায়ামন্ত্রবলে। পিতাপুত্র-ভ্রাতাভগ্নী-অতিথিঅভ্যাগতকে সুন্দর বন্ধনে বাঁধিয়া সে আপনার চারি দিকে গঠিত সজ্জিত করিয়া তোলে; বিচিত্র উপাদান লইয়া বড়ো সুনিপুণ হস্তে একখানি গৃহ নির্মাণ করে; কেবল গৃহ কেন, রমণী যেখানে যায় আপনার চারি দিককে একটি সৌন্দর্যসংযমে বাঁধিয়া আনে। নিজের চলাফেরা বেশভূষা কথাবার্তা আকার-ইঙ্গিতকে একটি অনির্বচনীয় গঠন দান করে। তাহাকে বলে শ্রী। ইহা তো বুদ্ধির কাজ নহে, অনির্দেশ্য প্রতিভার কাজ; মনের শক্তি নহে, আত্মার অভ্রান্ত নিগূঢ় শক্তি। এই-যে ঠিক সুরটি ঠিক জায়গায় গিয়া লাগে, ঠিক কথাটি ঠিক জায়গায় আসিয়া বসে, ঠিক কাজটি ঠিক সময়ে নিষ্পন্ন হয়, ইহা একটি মহারহস্যময় নিখিলজগৎকেন্দ্রভূমি হইতে স্বাভাবিক স্ফটিকধারার ন্যায় উচ্ছ্বসিত উৎস। সেই কেন্দ্রভূমিটিকে অচেতন না বলিয়া অতিচেতন নাম দেওয়া উচিত।

প্রকৃতিতে যাহা সৌন্দর্য, মহৎ ও গুণী লোকে তাহাই প্রতিভা, এবং নারীতে তাহাই শ্রী, তাহাই নারীত্ব। ইহা কেবল পাত্রভেদে ভিন্ন বিকাশ।

অতঃপর ব্যোম সমীরের মুখের দিকে চাহিয়া কহিল–তার পরে? তোমার লেখাটা শেষ করিয়া ফেলো।

সমীর কহিল–আর আবশ্যক কী? আমি যাহা আরম্ভ করিয়াছি তুমি তো তাহার একপ্রকার উপসংহার করিয়া দিয়াছ।

ক্ষিতি কহিল–কবিরাজ মহাশয় শুরু করিয়াছিলেন, ডাক্তার মহাশয় সাঙ্গ করিয়া গেলেন, এখন আমরা হরি হরি বলিয়া বিদায় হই। মন কী, বুদ্ধি কী, আত্মা কী, সৌন্দর্য কী এবং প্রতিভাই বা কাহাকে বলে, এ-সকল তত্ত্ব কস্মিন্‌কালে বুঝি নাই, কিন্তু বুঝিবার আশা ছিল, আজ সেটুকুও জলাঞ্জলি দিয়া গেলাম।

পশমের গুটিতে জটা পাকাইয়া গেলে যেমন নতমুখে সতর্ক অঙ্গুলিতে ধীরে ধীরে খুলিতে হয় স্রোতস্বিনী চুপ করিয়া বসিয়া যেন তেমনি ভাবে মনে মনে কথাগুলিকে বহুযত্নে ছাড়াইতে লাগিল।

দীপ্তিও মৌনভাবে ছিল; সমীর তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল–কী ভাবিতেছ?

দীপ্তি কহিল–বাঙালির মেয়েদের প্রতিভাবলে বাঙালির ছেলেদের মতো এমন অপরূপ সৃষ্টি কী করিয়া হইল তাই ভাবিতেছি।

আমি কহিলাম–মাটির গুণে সকল সময়ে শিব গড়িতে কৃতকার্য হওয়া যায় না।