কেবল সংকল্পের তালিকা বাড়াইয়া চলিলে কোনো লাভ নাই; কিন্তু যেমন করিয়া হউক, দেশের যথার্থ স্বকীয় একটি-একটি কাজকে সফল করিয়া তুলিতেই হইবে। সে কেবল সেই একটি বিশেষ কার্যের ফললাভ করিবার জন্য নহে; সকল কার্যেই ফললাভের অধিকার পাইবার জন্য। কারণ সফলতাই সফলতার ভিত্তি। একটাতে কৃতকার্য হইলেই অন্যটাতে কৃতকার্য হইবার দাবি পাকা হইতে থাকে, এই কথা মনে রাখিয়া দেশের কাজগুলিকে সফল করিবার দায় আমাদের প্রত্যেককে আপনার বলিয়া গ্রহণ করিতে হইবে। যাঁহার টাকা আছে তিনি নিশ্চিন্ত হইয়া টাকা ভোগ করিবেন না; যাঁহার বুদ্ধি আছে তিনি কেবল অন্যের প্রয়াসকে বিচার করিয়া দিনযাপন করিবেন না; দেশের কাজগুলিকে সফল করিবার জন্য যেখানেই আমাদের সকলের চেষ্টা মিলিত হইতে থাকিবে সেখানেই আমাদের স্বদেশ সত্য হইয়া উঠিবে।
দেশ-জিনিসটা তো কাহাকেও নিজের শক্তিতে উপার্জন করিয়া আনিতে হয় নাই। আমরা যে পৃথিবীতে এত জায়গা থাকিতে এই বাংলাদেশেই জন্মিতেছি ও মরিতেছি সে তো আমাদের নিজগুণে নহে, এবং বাংলাদেশেরও বিশেষ পুণ্যপ্রভাবে এমনও বলিতে পারি না। দেশ পশুপক্ষী-কীটপতঙ্গেরও আছে। কিন্ত স্বদেশকে নিজে সৃষ্টি করিতে হয়। সেইজন্যেই স্বদেশে কেহ হাত দিতে আসিলে স্বদেশীমাত্রেই উৎকন্ঠিত হইয়া উঠে; কেননা, সেটা যে বহুকাল হইতে তাহাদের নিজের গড়া—সেখানে যে তাহাদের বহু যুগের আহরিত মধু সমস্ত সঞ্চিত হইয়া আছে। যে-সকল দেশের লোক তাহাদের নিজের শরীর-মন-বাক্যের সমস্ত চেষ্টার দ্বারা জ্ঞানে প্রেমে কর্মে স্বদেশকে আপনি গড়িয়া তুলিতেছে, দেশের অন্নবস্ত্রস্বাস্থ্যজ্ঞানের সমস্ত অভাব আপনি পূরণ করিয়া তুলিতেছে, দেশকে তাহারাই স্বদেশ বলিতে পারে এবং স্বদেশ-জিনিসটা যে কী তাহাদিগকে বক্তৃতা করিয়া বুঝাইতেও হয় না; মৌমাছিকে আপন চাকের মর্যাদা বুঝাইবার জন্য বড়ো বড়ো পুঁথির দোহাই পাড়া সম্পূর্ণ অনাবশ্যক। আমরা দেশের কোনো সত্যকর্মে নিজেরা হাত না লাগাইয়াও আজ পঁচিশ-ত্রিশ বৎসর ইংরেজি ও বাংলায়, গদ্যে ও পদ্যে, স্বদেশের গৌরব ঘোষণা করিয়া আসিতেছি। কিন্তু এই স্বদেশের স্ব'টা যে কোথায় এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়া গোল্ডস্টুকর ম্যাক্স্মূলর মূয়রের প্রত্নতত্ত্ব খুঁজিয়া হয়রান হইতে হইয়াছে। শাণ্ডিল্যমুনির আশ্রমের জায়গাটার যদি আজ হঠাৎ আবিষ্কার হয় তবে আমি শাণ্ডিল্যগোত্রের দোহাই দিয়া সেটা দখল করিতে গেলে আইনের পেয়াদা তো মানিবে না। পাঁচ-সাত হাজার বৎসর পূর্বের উপর স্বদেশের স্বকীয়ত্বের বরাত দিয়া গৌরব করিতে বসিলে কেবল গলা ভাঙাই সার হয়। স্বকীয়ত্বকে অবিচ্ছিন্ন নিজের চেষ্টায় রক্ষা করিতে হয়। আজ আমাদের পক্ষে স্বদেশ কোথায়? সমস্ত দেশের মধ্যে যেখানেই আমরা নিজের শক্তিকে দেশবাসীদের জন্য কিছু-একটা গড়িয়া তুলিতে পারিয়াছি কেবলমাত্র সেইখানেই আমাদের স্বদেশ। এমনি করিয়া যাহা-কিছু গড়িয়া তুলিতে পারিব তাহাতেই আমাদের স্বদেশের বিস্তার ঘটিতে থাকিবে, সেই স্বদেশের উপর আমাদের সমস্ত প্রাণের দাবি জন্মিতে থাকিবে; অন্যে যাহা দয়া করিয়া দিবে তাহাতেও নহে এবং বহু হাজার বৎসর পূর্বে যে দলিল পাকা হইয়াছিল তাহাতেও না।
অদ্যকার সভায় আমার নিবেদন এই, সাহিত্যপরিষদের মধ্যে আপনারা সকলে মিলিয়া স্বদেশকে সত্য করিয়া তুলুন। বাংলাদেশের প্রত্যেক জেলা এবং প্রত্যেক জেলার প্রত্যেক বাঙালি সাহিত্যপরিষদের মধ্যে নিজের ইচ্ছা ও চেষ্টাকে একত্রে জাগ্রত করিয়া আজ যাহা অস্ফুট আছে তাহা স্পষ্ট করুন, যাহা ক্ষুদ্র আছে তাহাকে মহৎ করুন। কোন্খানে এই পরিষদের কী অসম্পূর্ণতা আছে তাহা লইয়া প্রশ্ন করিবেন না, ইহাকে সম্পূর্ণ করিয়া তুলিয়া প্রত্যেকে গৌরবলাভ করুন। দেবপ্রতিমা ঘরে আসিয়া পড়িলে গৃহস্থকে তাহার পূজা সারিতেই হয়; আজ বাঙালির ঘরে তিনটি দেবপ্রতিমা আসিয়াছে—সাহিত্যপরিষৎ, শিক্ষাপরিষৎ ও