মানবসমাজের সে বাল্যকাল কোথায় গেল যখন প্রকৃত এবং অপ্রকৃত, ঘটনা এবং কল্পনা, কয়টি ভাইবোনের মতো একান্নে এবং একত্রে খেলা করিতে করিতে মানুষ হইয়াছিল? আজ তাহাদের মধ্যে যে এতবড়ো একটা গৃহবিচ্ছেদ ঘটিবে তাহা কখনো কেহ স্বপ্নেও জানিত না।
এক সময়ে রামায়ণ-মহাভারত ছিল ইতিহাস। এখনকার ইতিহাস তাহার সহিত কুটুম্বিতা স্বীকার করিতে অত্যন্ত কুণ্ঠিত হয়; বলে, কাব্যের সহিত পরিণীত হইয়া উহার কুল নষ্ট হইয়াছে। এখন তাহার কুল উদ্ধার করা এতই কঠিন হইয়াছে যে, ইতিহাস তাহাকে কাব্য বলিয়াই পরিচয় দিতে ইচ্ছা করে। কাব্য বলে, ভাই ইতিহাস, তোমার মধ্যে অনেক মিথ্যা আছে, আমার মধ্যেও অনেক সত্য আছে; এসো আমরা পূর্বের মতো আপস করিয়া থাকি। ইতিহাস বলে, না ভাই, পরস্পরের অংশ বাঁটোয়ারা করিয়া বুঝিয়া লওয়া ভালো। জ্ঞান-নামক আমিন সর্বত্রই সেই বাঁটোয়ারাকার্য আরম্ভ করিয়াছে। সত্যরাজ্য এবং কল্পনারাজ্যের মধ্যে একটা পরিষ্কার রেখা টানিবার জন্য সে বদ্ধপরিকর। ইতিহাসের ব্যতিক্রম করা অপরাধে ঐতিহাসিক উপন্যাসের বিরুদ্ধে যে নালিশ উত্থাপিত হইয়াছে তাহাতে বর্তমানকালে সাহিত্যপরিবারের এই গৃহবিচ্ছেদ প্রমাণ হয়।
এ নালিশ কেবল আমাদের দেশে নয়, কেবল নবীনবাবু এবং বঙ্কিমবাবু অপরাধী নহেন, ঐতিহাসিক উপন্যাস-লেখকদের আদি এবং আদর্শ স্কটও নিষ্কৃতি পান নাই।
আধুনিক ইংরাজ ঐতিহাসিকদের মধ্যে ফ্রীম্যান সাহেবের নাম সুবিখ্যাত। উপন্যাসে ইতিহাসের যে বিকার ঘটে সেটার উপরে তিনি আক্রোশ প্রকাশ করিয়াছেন। তিনি বলেন, যাঁহারা য়ুরোপের ধর্মযুদ্ধযাত্রা-যুগ (The Age of the Crusades) সম্বন্ধে কিছু জানিতে ইচ্ছা করেন তাঁহারা যেন স্কটের আইভ্যান্হো পড়িতে বিরত থাকেন।
অবশ্য, য়ুরোপের ধর্মযুদ্ধযাত্রা-যুগ সম্বন্ধে প্রকৃত তথ্য জানা আবশ্যক সন্দেহ নাই, কিন্তু স্কটের আইভ্যান্হোর মধ্যে চিরন্তন মানব-ইতিহাসের যে নিত্যসত্য আছে তাহাও আমাদের জানা আবশ্যক। এমন-কি, তাহা জানিবার আকাঙ্ক্ষা আমাদের এত বেশি যে, ক্রুজেড-যুগ সম্বন্ধে ভুল সংবাদ পাইবার আশঙ্কাসত্ত্বেও ছাত্রগণ অধ্যাপক ফ্রীম্যানকে লুকাইয়া আইভ্যান্হো পাঠ করিবার প্রলোভন সম্বরণ করিতে পারিবে না।
এখন আলোচ্য এই যে, ইতিহাসের বিশেষ সত্য এবং সাহিত্যের নিত্য সত্য উভয় বাঁচাইয়াই কি স্কট আইভ্যান্হো লিখিতে পারিতেন না?
পারিতেন কি না সে কথা আমাদের পক্ষে নিশ্চয় করিয়া বলা কঠিন। দেখিতেছি তিনি সে কাজ করেন নাই।
এমন হইতে পারে, তিনি যে ইচ্ছা করিয়া করেন নাই তাহা নহে। অধ্যাপক ফ্রীম্যান ক্রুজেড-যুগ সম্বন্ধে যতটা জানিতেন স্কট ততটা জানিতেন না। স্কটের সময় প্রমাণ-বিশ্লেষণ এবং ঐতিহাসিক তথ্যানুসন্ধান এতদূর অগ্রসর হয় নাই।
প্রতিবাদী বলিবেন, যখন লিখিতে বসিয়াছেন তখন ভালো করিয়া জানিয়া লেখাই উচিত ছিল।
কিন্তু এ জানার শেষ হইবে কবে? কবে নিশ্চয় জানিব ক্রুজেড সম্বন্ধে সমস্ত প্রমাণ নিঃশেষ হইয়া গেছে? কেমন করিয়া বুঝিব অদ্য যে ঐতিহাসিক সত্য ধ্রুব বলিয়া জানিব কল্য নূতনাবিষ্কৃত দলিলের জোরে তাহাকে ঐতিহাসিক সিংহাসন হইতে বিচ্যুত হইতে হইবে না? অদ্যকার প্রচলিত ইতিহাসের উপর নির্ভর করিয়া যিনি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখিবেন কল্যকার নূতন ইতিহাসবেত্তা তাঁহাকে নিন্দা করিলে কী বলিব?