‘যদি চাই’ এ কথা বলিতে হইল। কারণ, পূর্বেই বলিয়াছি আমরা সকলে চাই না, ঈশ্বরকে উপলক্ষ করিয়া আর-কিছু চাই। কিন্তু যদি চাই তো কী করিব?
তবে, যাহাতে বাধা যাহাতে অন্ধকার তাহা সাবধানে এড়াইয়া যে দিকে আলোক আপনাকে প্রকাশ করে সেই পথ দিয়া পাখা মেলিয়া আকাশের দিকে উড়িতে হইবে। সে পথ কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়ের পথ ধূলির পথ পৃথিবীর পথ নহে, তাহা পদচিহ্নহীন বায়ুর পথ আলোকের পথ আকাশের পথ। আমাদের পক্ষে সেই এক পথ।
যাঁহারা মুক্তক্ষেত্রে বাস করেন তাঁহারা মাটিতে বসিয়াও আকাশের আলো পান, কিন্তু যাহারা জটিল প্রবৃত্তিজালে পরিবৃত হইয়া আছে তাহাদিগকে একেবারে পৃথিবীর দিক হইতে উড়িয়া বাহির হইয়া যাইতে হয়।
তাহা না করিয়া আমরা যদি আমাদেরই প্রবৃত্তি আমাদেরই আকৃতি দিয়া দেবতা গড়ি তবে তাহার মধ্যে মুক্তি কোন্খানে? যদি তাহাকে স্নান করাই, খাওয়াই, মশারিতে শোয়াই, এমন-কি, তাহার জন্য নটী নিযুক্ত করিয়া রাখি তবে তাহার ফল কী হয়? তবে নিজের প্রবৃত্তিকেই দেবতা করিয়া পূজা করা হয়। আমাদের লোভ আমাদের হিংসা আমাদের ক্ষুদ্রতাকে দেবতারূপে অমর করিয়া রাখি। এই কারণেই কালীকে দস্যু আপন দস্যুবৃত্তির সহায় বলিয়া জ্ঞান করে, মিথ্যাশপথকারী আদালতে জয়লাভের জন্য পশু মানত করে, এমন-কি, যে সকল অন্যায়-অবিচার-দুষ্কর্ম মনুষ্যলোকে গর্হিত বলিয়া খ্যাত, দেবচরিত্রে তাহাও অনিন্দনীয় বলিয়া স্থান পায়।
আমাদের দেশের দেবতা কি কেবল মূর্তিতেই বদ্ধ যে রূপক ভাঙিয়া তাহার মধ্যে আমরা ভাবের স্বাধীনতা লাভ করিব? চার হাতকে যেন আমরা চারিদিক্বর্তী কর্মশীলতা বলিয়া মনে করিলাম কিন্তু পুরাণে উপপুরাণে যাত্রায় কথকতায় তাঁহার জন্মমৃত্যুবিবাহ-রাগদ্বেষ-সুখদুঃখ-দৈন্যদুর্বলতার বিচিত্র পাঠ ও পাঠান্তর হইতে মনকে মুক্ত করিব কেমন করিয়া? যতপ্রকার কৌশলে মানুষের মনকে ভুলাইয়া একেবারে আটেঘাটে বাঁধা যায় তাহার কোনোটাই ত্রুটি নাই। এবং এতপ্রকার সুদৃঢ় স্থূল শৃঙ্খলে চতুর্দিক হইতে সযত্ন বন্ধনকে গ্রন্থকার যদি তাঁহার নির্গুণ ব্রহ্মলাভের সোপান বলিয়া গণ্য করেন তবে মাছির পক্ষে মাকড়সার জালে পড়াই আকাশে উড়িবার উপায় মনে করা অসংগত হইবে না।
দেবচরিত্র সম্বন্ধে যে-সকল ভ্রষ্ট আদর্শের কল্পনা আমাদের দেশে শাখাপল্লবিত হইয়া চারি দিকে শিকড় বিস্তার করিয়াছে, তাহা কল্পনার বিকার; গ্রন্থকার বোধ করি তাহা হিন্দুসমাজের অধোগতির ফল বলিয়া জ্ঞান করেন এবং সম্ভবত তাহা সংশোধন করিয়া লইতে উপদেশ দেন। সংশোধনের উপায় কী? তিনি এক স্থলে বলিয়াছেন–
‘সকল শাস্ত্রের মূলে এক বেদ, এক শ্রুতি– এক শ্রুতির দ্বারা সকল শাস্ত্রের বিরোধ ভঞ্জন করিবার বিধি রহিয়াছে।’
বিধি রহিয়াছে কিন্তু কেহ কখনো চেষ্টা করিয়াছেন? পৌরাণিক ধর্মের সহিত বৈদিক ধর্মের সামঞ্জস্য স্থাপন করিয়া কোনো পণ্ডিত আজ পর্যন্ত হিন্দুধর্মের একটা অখণ্ড আদর্শ প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন কি? ইহা কি সকলের দ্বারা সাধ্য?
পৌরাণিক ধর্ম ঐতিহাসিক হিন্দুধর্ম। কালক্রমে হিন্দুর অনেক পরিবর্তন হইয়াছে। বৈদিক আর্যগণ যে সমাজ, যে রীতি, যে বিশ্বাস, যে মানসিক প্রকৃতি লইয়া ভারতবর্ষে প্রবেশ করিয়াছিলেন অনার্যদের সংঘর্ষে মিশ্রণে বিচিত্র অবস্থান্তরে স্বভাবের নিয়মে ক্রমশই তাহা রূপান্তরিত হইয়া আসিয়াছে। সেই-সকল নব নব অভিব্যক্তি নব নব পুরাণে আপনাকে আকারবদ্ধ করিয়াছে। বেদ যে অবস্থার শাস্ত্র, পুরাণ সে অবস্থার শাস্ত্র নহে। সুতরাং বেদকেই যদি প্রমাণ বলিয়া মানা যায় তবে পুরাণকে ছাড়িতে হয় এবং পুরাণকে প্রবল বলিয়া মানিলে বেদকে পরিহার করিতে হয়। এমন-কি, গ্রন্থকার নিজে বলিয়াছেন এবং ফলেও দেখা যায়, এক পুরাণকে