আমরা ‘ঐতিহাসিক চিত্র’ নামক একখানি ঐতিহাসিক পত্রের মুদ্রিত প্রস্তাবনা প্রাপ্ত হইয়াছি। শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয়ের সম্পাদকতায় তাহা প্রকাশিত হইবে।
এই প্রস্তাবনায় লিখিত হইয়াছে– ‘আমাদের ইতিহাসের অনেক উপকরণ বিদেশীয় পরিব্রাজকগণের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ; তাহা বহুভাষায় লিখিত বলিয়া আমাদের নিকট অপরিজ্ঞাত ও অনাদৃত। মুসলমান বা ইউরোপীয় সমসাময়িক ইতিহাস লেখকগণ যে-সকল বিবরণ লিখিয়া গিয়াছেন, তাহারও অদ্যাপি বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয় নাই। পুরাতন রাজবংশের কাগজপত্রের মধ্যে যে সকল ঐতিহাসিক তত্ত্ব লুক্কায়িত আছে তাহার অনুসন্ধান লইবারও ব্যবস্থা দেখা যায় না।
‘নানা ভাষায় লিখিত ভারতভ্রমণকাহিনী ও ইতিহাসাদি প্রামাণ্য গ্রন্থের অনুবাদ, অনুসন্ধানলব্ধ নবাবিষ্কৃত ঐতিহাসিক তথ্য, আধুনিক ইতিহাসাদির সমালোচনা এবং বাঙালি রাজবংশ ও জমিদারবংশের পুরাতত্ত্ব প্রকাশিত করাই (এই প্রস্তাবিত পত্রের) মুখ্য উদ্দেশ্য।’
প্রাচীন গ্রীস রোম এবং আধুনিক প্রায় সকল সভ্যদেশেই ইতিহাসের প্রতি পক্ষপাত যেরূপ প্রকাশ পাইয়াছে ভারতবর্ষে কখনো তেমন ছিল না, ইহাতে বোধ করি দুই মত হইবে না। মান্ধাতার সমকালে আমাদের দেশে হয়তো সবই ছিল– তখন টেলিগ্রাফ, রেলগাড়ি, বেলুন, ম্যাক্সিম বন্দুক, ডারউইনের অভিব্যক্তিবাদ, এবং গ্যানো-রচিত প্রকৃতিবিজ্ঞান ছিল এমন অনেকে আভাস দিয়া থাকেন– কিন্তু, তখন ইতিহাস ছিল না। থাকিলে এমন-সকল কথা অল্প শুনা যাইত।
কিন্তু আধুনিক ভারতবর্ষে, যে সময়ে রাজপুতদের জনবন্ধন দৃঢ় ছিল তখন তাহাদের মধ্যে, উপযুক্ত মাটিতে উপযুক্ত চাষের মতো, ইতিহাস আপনি উদ্ভিন্ন হইয়া উঠিত।
আধুনিক ভারতে যখন হইতে মারাঠারা শিবাজীর প্রতিভাবলে এক জনসম্প্রদায়রূপে বজ্রের মতো বাঁধিয়া গিয়াছিল এবং সেই বজ্র যখন জীর্ণ মোগল সাম্রাজ্যের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বিদ্যুৎ-বেগে ভাঙিয়া পড়িতেছিল, তখন হইতে তাহাদের ইতিহাস রচনার স্বাভাবিক কারণ ঘটে। তাহাদের ‘বখর’ নামধারী ইতিহাসগুলি প্রাচীন মহারাষ্ট্র সাহিত্যের প্রধান অঙ্গ।
শিখদের ধর্মগ্রন্থ এবং তাহাদের জনসম্প্রদায়গঠনের ইতিহাস একত্র সম্মিলিত। তাহাদের ধর্মমতে একেশ্বরবাদের মহান ঐক্য স্বভাবতই জাতীয় ঐক্যের কারণ হইয়াছিল। তাহারা যেমন ধর্মে এক, তেমনি কর্মে এক, তেমনি বলে এক হইয়া উঠিয়াছিল। তাহাদের ধর্মগ্রন্থ একই কালে পুরাণ এবং ইতিহাস।
আসল কথা এই যে, জীবের ধর্ম যেমন বর্তমানে জীবনরক্ষা এবং ভবিষ্যতে বংশানুক্রমে আপনাকে স্থায়ী করিবার চেষ্টা, তেমনি যখন বহুসংখ্যক বিচ্ছিন্ন লোককে কোনো একটি বিশেষ মত বা ভাব বা ধারাবাহিক স্মৃতিপরম্পরা এক জীবন দিয়া এক জীব করিয়া তোলে তখন সে বহিঃশত্রুর আক্রমণে খাড়া হইয়া দাঁড়াইতে পারে এবং ভবিষ্যৎ-অভিমুখে আপন ব্যক্তিত্ব, আপন সম্প্রদায়গত ঐক্যকে প্রেরণ করিবার জন্য যত্নবান হইয়া উঠে। ইতিহাস তাহার অন্যতম উপায়। এইজন্য কীটসমাজের পক্ষে বংশানুক্রমে প্রবালশৈলরচনার ন্যায় বিশেষ ঐক্যবদ্ধ জনসম্প্রদায়ের পক্ষে ইতিহাসরচনা প্রকৃতিগত ধর্ম।
শাস্ত্র পুরাণ জনসমাজের সম্পূর্ণ ইতিহাস না হইলেও তাহা ধর্মসমাজের ইতিহাস। ধর্মমণ্ডলী আপন ধর্মের মহত্ত্ব সৌন্দর্য প্রাচীনতা সাধুদৃষ্টান্তমালা পুরাণে শাস্ত্রে গ্রথিত করিয়া ধর্মমতপ্রবাহকে অখণ্ড আকারে কাল হইতে কালান্তরে সঞ্চারিত করিয়া রাখে এবং সেই পুরাতন ঐক্যসূত্রে আপন সম্প্রদায়কে দূরকালবদ্ধ বৃহৎ এবং সুদৃঢ় করিয়া তোলে।