বঙ্কিম এই গ্রন্থের অনেক স্থলেই যে-সকল সামাজিক তর্ক উত্থাপন করিয়াছেন তাহাতে গ্রন্থের বিষয়টি বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছে মাত্র, আর কোনো ফল হয় নাই। ‘কৃষ্ণের বহুবিবাহ’ শীর্ষক অধ্যায়ে রুক্ষ্মিণী ব্যতীত কৃষ্ণের অন্য স্ত্রী ছিল না ইহাই প্রমাণ করিয়া লেখক সর্বশেষে তর্ক তুলিয়াছেন যে, পুরুষের বহুবিবাহ সকল অবস্থাতেই অধর্ম এ কথা ঠিক নহে। তিনি বলিয়াছেন–
‘সচরাচর অকারণে পুরুষের একাধিক বিবাহ অধর্ম। কিন্তু সকল অবস্থাতে নহে। যাহার পত্নী কুষ্ঠগ্রস্ত বা এরূপ রুগ্ণ যে সে কোনোমতেই সংসারধর্মের সহায়তা করিতে পারে না, তাহার যে দারান্তর পরিগ্রহ পাপ, এমন কথা আমি বুঝিতে পারি না। যাহার স্ত্রী ধর্মভ্রষ্টা কুলকলঙ্কিনী, সে যে কেন আদালতে না গিয়া দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করিতে পারিবে না তাহা আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আসে না। যাহার উত্তরাধিকারীর প্রয়োজন, কিন্তু স্ত্রী বন্ধ্যা, সে যে কেন দারান্তর গ্রহণ করিবে না, তাহা বুঝিতে পারি না। যদি য়ুরোপের এ কুশিক্ষা না হইত, তাহা হইলে, বোনাপার্টিকে জসেফাইনের বর্জনরূপ অতি ঘোর নারকী পাতকে পতিত হইতে হইত না; অষ্টম হেনরিকে কথায় কথায় পত্মীহত্যা করিতে হইত না। য়ুরোপে আজি কালি সভ্যতার উজ্জ্বলালোকে এই কারণে অনেক পত্নীহত্যা, পতিহত্যা হইতেছে। আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বিশ্বাস যাহাই বিলাতি তাহাই চমৎকার, পবিত্র, দোষশূন্য, ঊর্ধ্বাধঃ চতুর্দশ পুরুষের উদ্ধারের কারণ। আমার বিশ্বাস, আমরা যেমন বিলাতের কাছে অনেক শিখিতে পারি, বিলাতও আমাদের কাছে অনেক শিখিতে পারে। তাহার মধ্যে এই বিবাহতত্ত্ব একটা কথা।’
কৃষ্ণ যখন একাধিক বিবাহ করেন নাই তখন বিবাহসম্বন্ধীয় এই তর্ক নিতান্তই অনাবশ্যক; তাহা ছাড়া তর্কটারই বা কী মীমাংসা হইল। প্রথম স্থির হইল, যাহার স্ত্রী রুগণ্ অথবা ভ্রষ্টা অথবা বন্ধ্যা সে দ্বিতীয়বার বিবাহ করিতে পারে। কিন্তু য়ুরোপে রুগণা, ভ্রষ্টা এবং বন্ধ্যার স্বামী সহজে দারান্তর পরিগ্রহ করিতে পারে না বলিয়াই যে, সেখানকার সভ্যতার উজ্জ্বলালোকে এত পত্নীহত্যা হইতেছে তাহা নহে; অনেক সময় পত্নীর প্রতি বিরাগ ও অন্যের প্রতি অনুরাগ বশত হত্যা ঘটনা অধিকতর সম্ভবপর। যদি সে হত্যা নিবারণ করিতে হয় তবে অন্য স্ত্রীর প্রতি অনুরাগ সঞ্চারকেও দ্বিতীয় স্ত্রী-গ্রহণের ধর্মসংগত বিধান বলিয়া স্থির করিতে হয়। তাহা হইলে ‘সচরাচর অকারণে পুরুষের একাধিক বিবাহ অধর্ম এ কথাটার এই তাৎপর্য দাঁড়ায় যে, যখন দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করিতে যাইবে তখন যেন একটা কোনো কারণ থাকে, কাজটা যেন অকারণে না হয়। অর্থাৎ যদি তোমার স্ত্রী রুগ্ণ অক্ষম হয় তবে তুমি বিবাহ করিতে পার, অথবা যদি অন্য স্ত্রী বিবাহ করিতে তোমার ইচ্ছা বোধ হয় তাহা হইলেও তুমি বিবাহ করিতে পার; কারণ, সেইরূপ ইচ্ছার বাধা পাইয়া ইংলণ্ডের অষ্টম হেনরি পত্নীহত্যা করিয়াছিলেন। কিন্তু কোনো কারণ না থাকিলে বিবাহ করিয়ো না। জিজ্ঞাস্য এই যে, স্বামীকে যে যুক্তি অনুসারে যে-সকল স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী করা হইল, ঠিক সেই যুক্তি অনুসারে অনুরূপ স্থলে স্ত্রীর প্রতি অনুরূপ ক্ষমতা অর্পণ করা যায় কি না, এবং আমাদের সমাজে স্ত্রীর সেই-সকল স্বাধীন ক্ষমতা না থাকাতে স্ত্রী ‘অতি ঘোর নারকী পাতকে পতিত’ হয় কি না।
ইহার অনতিপরেই সুভদ্রাহরণ কার্যটা যে বিশেষ দোষের হয় নাই ইহাই প্রতিপন্ন করিতে গিয়া লেখক, ‘মালাবারী’ নামক এক পারসি–সম্ভবত যাঁহার খ্যাতিপুষ্প বর্তমান কালের গুটিকয়েক সংবাদপত্রপুটের মধ্যেই কীটের দ্বারা জীর্ণ হইতে থাকিবে–তাঁহার প্রতি একটা খোঁচা দিয়া আর-একটা সামাজিক তর্ক তুলিয়াছেন। সে তর্কটারও মীমাংসা কিছুমাত্র সন্তোষজনক হয় নাই, অথচ লেখক অধীরভাবে অসহিষ্ণু ভাষায় অনেকের সঙ্গে অনর্থক একটা কলহ করিয়াছেন।