স্বচ্ছন্দে রাজার মতো
ভূমে আছি নিদ্রাগত,
প্রাতে উঠে দেখিব মিহিরে।’
কলিকাতার ছেলে পল্লীগ্রামের এই সুখময় চিত্রে যে ব্যাকুল হইয়া উঠিবে ইহাতে বিচিত্র কিছুই নাই। ইহা হইতে বুঝা যায় অসন্তোষ মানবপ্রকৃতির সহজাত। অট্টালিকা অপেক্ষা নড়বোড়ে পাতার কুটিরে যে সুখের অংশ অধিক আছে অট্টালিকাবাসী বালকের মনে এ মায়া কে জন্মাইয়া দিল? আদিম মানবপ্রকৃতি। কবি নহে। কবিকে যিনি ভুলাইয়াছেন সেই মহামায়া। কবিতায় অসন্তোষ-গানের বাহুল্য দেখা যায় বলিয়া অনেকে আক্ষেপ করিয়া থাকেন। কিন্তু দোষ কাহাকে দিব? অসন্তোষ মানুষকে কাজ করাইতেছে, আকাঙ্ক্ষা কবিকে গান গাওয়াইতেছে। সন্তোষ এবং পরিতৃপ্তি যতই প্রার্থনীয় হউক তাহাতে কার্য এবং কাব্য উভয়েরই ব্যাঘাত করিয়া থাকে। অ যেমন বর্ণমালার আরম্ভ এবং সমস্ত ব্যঞ্জনবর্ণের সহিত যুক্ত, অসন্তোষ ও অতৃপ্তি সেইরূপ সৃজনের আরম্ভে বর্তমান এবং সমস্ত মানবপ্রকৃতির সহিত নিয়ত সংযুক্ত। এইজন্যই তাহা কবিতায় প্রাধান্য লাভ করিয়াছে, কবিদিগের মানসিক ক্ষিপ্ততা বা পরিপাকশক্তির বিকারবশত নহে। কৃষক-কবি যখন কবিতা রচনা করে তখন সে মাঠের শোভা কুটিরের সুখ বর্ণনা করে না–নগরের বিস্ময়জনক বৈচিত্র্য তাহার চিত্ত আকর্ষণ করে–তখন সে গাহিয়া ওঠে–
‘কী কল বানিয়েছে সাহেব কোম্পানি!
কলেতে ধোঁয়া ওঠে আপনি, সজনি!’
কলের বাঁশি যাহারা শুনিতেছে মাঠের ‘বাঁশের বাঁশরি’ শুনিয়া তাহারা ব্যাকুল হয় এবং যাহারা বাঁশের বাঁশরি বাজাইয়া থাকে কলের বাঁশি শুনিলে তাহাদের হৃদয় বিচলিত হইয়া উঠে। এইজন্য শহরের কবিও সুখের কথা বলে না, মাঠের কবিও আকাঙ্ক্ষার চাঞ্চল্য গানে প্রকাশ করিতে চেষ্টা করে।
সুখ চিরকালই দূরবর্তী, এইজন্য কবি যখন গাহিলেন–‘সর্বদাই হু হু করে মন’ তখন বালকের অন্তরেও তাহার প্রতিধ্বনি জাগিয়া উঠিল। কবি যখন বলিলেন–
‘কভু ভাবি ত্যেজে এই দেশ
যাই কোনো এ হেন প্রদেশ
যথায় নগর গ্রাম
নহে মানুষের ধাম,
পড়ে আছে ভগ্ন-অবশেষ।
গর্বভরা অট্টালিকা যায়
এবে সব গড়াগড়ি যায়–
বৃক্ষলতা অগণন
ঘোর করে আছে বন,
উপরে বিষাদবায়ু বায়।
প্রবেশিতে যাহার ভিতরে
ক্ষীণপ্রার্থী নরে ত্রাসে মরে,
যথায় শ্বাপদদল