“আপনি ব্রাহ্মণ? নমস্কার। আপনার নাম রমেশবাবু, সে আমি পূর্বেই খবর লইয়াছি— তবু দেখুন আমাদের দেশে নাম-জিজ্ঞাসাটা পরিচয়ের একটা প্রণালী। ওটা ভদ্রতা। আজকাল কেহ কেহ ইহাতে রাগ করেন। আপনি যদি রাগ করিয়া থাকেন তো শোধ তুলুন। আমাকে জিজ্ঞাসা করুন, আমি নিজের নাম বলিব, বাপের নাম বলিব, পিতামহের নাম বলিতে আপত্তি করিব না।”
রমেশ হাসিয়া কহিল, “আমার রাগ এত বেশি ভয়ংকর নয়, আপনার একলার নাম পাইলেই আমি খুশি হইব।”
“আমার নাম ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী। পশ্চিমে সকলেই আমাকে ‘খুড়ো’ বলিয়া জানে। আপনি তো হিস্ট্রি পড়িয়াছেন? ভারতবর্ষে ভরত ছিলেন চক্রবর্তী রাজা, আমি তেমনি সমস্ত পশ্চিম-মুল্লুকের চক্রবর্তী-খুড়ো। যখন পশ্চিমে যাইতেছেন তখন আমার পরিচয় আপনার অগোচর থাকিবে না। কিন্তু মহাশয়ের কোথায় যাওয়া হইতেছে?”
রমেশ কহিল, “এখনো ঠিক করিয়া উঠিতে পারি নাই।”
ত্রৈলোক্য। আপনার ঠিক করিয়া উঠিতে বিলম্ব হয়, কিন্তু জাহাজে উঠিতে তো দেরি সহে নাই।
রমেশ কহিল, “একদিন গোয়ালন্দে নামিয়া দেখিলাম, জাহাজে বাঁশি দিয়াছে। তখন এটা বেশ বোঝা গেল, আমার মন স্থির করিতে যদি বা দেরি থাকে কিন্তু জাহাজ ছাড়িতে দেরি নাই। সুতরাং যেটা তাড়াতাড়ির কাজ সেইটেই তাড়াতাড়ি সারিয়া ফেলিলাম।”
ত্রৈলোক্য। নমস্কার মহাশয়। আপনার প্রতি আমার ভক্তি হইতেছে। আমাদের সঙ্গে আপনার অনেক প্রভেদ। আমরা আগে মতি স্থির করি, তাহার পরে জাহাজে চড়ি— কারণ আমরা অত্যন্ত ভীরুস্বভাব। আপনি যাইবেন এটা স্থির করিয়াছেন, অথচ কোথায় যাইবেন কিছুই স্থির করেন নাই, এ কি কম কথা! পরিবার সঙ্গেই আছেন?
‘হাঁ’ বলিয়া এ প্রশ্নের উত্তর দিতে রমেশের মুহূর্তকালের জন্য খটকা বাধিল। তাহাকে নীরব দেখিয়া চক্রবর্তী কহিলেন, “আমাকে মাপ করিবেন— পরিবার সঙ্গে আছেন, সে খবরটা আমি বিশ্বস্তসূত্রে পূর্বেই জানিয়াছি। বউমা ঐ ঘরটাতে রাঁধিতেছেন, আমিও পেটের দায়ে রান্নাঘরের সন্ধানে সেইখানে গিয়া উপস্থিত। বউমাকে বলিলাম, ‘মা, আমাকে দেখিয়া সংকোচ করিয়ো না, আমি পশ্চিম-মুল্লুকের একমাত্র চক্রবর্তীখুড়ো।’ আহা, মা যেন সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা! আমি আবার কহিলাম, ‘মা, রান্নাঘরটি যখন দখল করিয়াছ তখন অন্ন হইতে বঞ্চিত করিলে চলিবে না, আমি নিরুপায়।’ মা একটুখানি মধুর হাসিলেন, বুঝিলাম প্রসন্ন হইয়াছেন, আজ আর আমার ভাবনা নাই। পাঁজিতে শুভক্ষণ দেখিয়া প্রতিবারই তো বাহির হই, কিন্তু এমন সৌভাগ্য ফি বারে ঘটে না। আপনি কাজে আছেন, আপনাকে আর বিরক্ত করিব না— যদি অনুমতি করেন তো বউমাকে একটু সাহায্য করি। আমরা উপস্থিত থাকিতে তিনি পদ্মহস্তে বেড়ি ধরিবেন কেন? না না, আপনি লিখুন, আপনাকে উঠিতে হইবে না— আমি পরিচয় করিয়া লইতে জানি।”
এই বলিয়া চক্রবর্তী-খুড়া বিদায় হইয়া রান্নাঘরের দিকে গেলেন। গিয়াই কহিলেন, “চমৎকার গন্ধ বাহির হইয়াছে, ঘণ্টা যা হইবে তা মুখে তুলিবার পূর্বেই বুঝা যাইতেছে। কিন্তু অম্বলটা আমি রাঁধিব মা; পশ্চিমের গরমে যাহারা বাস না করে অম্বলটা তাহারা ঠিক দরদ দিয়া রাঁধিতে পারে না। তুমি ভাবিতেছ, বুড়াটা বলে কী– তেঁতুল নাই, অম্বল রাঁধিব কি দিয়া? কিন্তু আমি উপস্থিত থাকিতে তেঁতুলের ভাবনা তোমাকে ভাবিতে হইবে না। একটু সবুর করো, আমি সমস্ত জোগাড় করিয়া আনিতেছি।”
বলিয়া চক্রবর্তী কাগজে-মোড়া একটা ভাঁড়ে কাসুন্দি আনিয়া উপস্থিত করিলেন। কহিলেন, “আমি অম্বল যা রাঁধিব তা