কমলা উদ্বিগ্ন হইয়া কহিল, “না না, তোকে আর স্টীমার হইতে নামিতে দিব না, এবার তুই ভাঙায় পড়িয়া থাকিলে তোকে কেহ আর তুলিয়া লইবে না।”
উমেশ কহিল, “ডাঙায় নামিব কেন? আজ ভোরে খালাসিদের জালে খুব বড়ো মাছ পড়িয়াছে; এক-আধটা বেচিতেও পারে।”
শুনিয়া দ্রুতবেগে কমলা একটা টাকা আনিয়া উমেশের হাতে দিল; কহিল, “যাহা লাগে দিয়া বাকি ফিরাইয়া আনিস।”
উমেশ মাছ আনিল, কিন্তু কিছু ফিরাইয়া আনিল না; বলিল, ‘এক টাকার কমে কিছুতেই দিল না।”
কথাটা যে খাঁটি সত্য নহে তাহা কমলা বুঝিল; একটু হাসিয়া কহিল, “এবার স্টীমার থামিলে টাকা ভাঙাইয়া রাখিতে হইবে।”
উমেশ গম্ভীরমুখে কহিল, “সেটা খুব দরকার। আস্ত টাকা একবার বাহির হইলে ফেরানো শক্ত।”
আহার করিতে প্রবৃত্ত হইয়া রমেশ কহিল, “বড়ো চমৎকার হইয়াছে। কিন্তু এ-সমস্ত জোটাইলে কোথা হইতে? এ যে রুইমাছের মুড়ো।” বলিয়া মুড়োটা সযত্নে তুলিয়া ধরিয়া কহিল, “এ তো স্বপ্ন নয়, মায়া নয়, মতিভ্রম নয়— এ যে সত্যই মুড়ো— যাহাকে বলে রোহিত মৎস্য তাহারই উত্তমাঙ্গ।”
এইরূপে সেদিনকার মধ্যাহ্নভোজন বেশ সমারোহের সহিত সম্পন্ন হইল। রমেশ ডেকে আরাম-কেদারায় গিয়া পরিপাক-ক্রিয়ায় মনোযোগ দিল। কমলা তখন উমেশকে খাওয়াইতে বসিল। মাছের চচ্চড়িটা উমেশের এত ভালো লাগিল যে, ভোজনের উৎসাহটা কৌতুকাবহ না হইয়া ক্রমে আশঙ্কাজনক হইয়া উঠিল। উৎকণ্ঠিত কমলা কহিল, “উমেশ, আর খাস নে। তোর জন্য চচ্চড়িটা রাখিয়া দিলাম, আবার রাত্রে খাইবি।”
এইরূপে দিবসের কর্মে ও হাস্যকৌতুকে প্রাতঃকালের হৃদয়ভারটা কখন যে দূর হইয়া গেল, তাহা কমলা জানিতে পারিল না।
ক্রমে দিন শেষ হইয়া আসিল। সূর্যের আলো বাঁকা হইয়া দীর্ঘতরচ্ছটায় পশ্চিমদিক হইতে জাহাজের ছাদ অধিকার করিয়া লইল। স্পন্দমান জলের উপর বৈকালের মন্দীভূত রৌদ্র ঝিক্মিক্ করিতেছে। নদীর দুই তীরে নবীনশ্যাম শারদশস্যক্ষেত্রের মাঝখানকার সংকীর্ণ পথ দিয়া গ্রামরমণীরা গা ধুইবার জন্য ঘট কক্ষে করিয়া চলিয়া আসিতেছে।
কমলা পান সাজা শেষ করিয়া, চুল বাঁধিয়া, মুখ-হাত ধুইয়া, কাপড় ছাড়িয়া সন্ধ্যার জন্য যখন প্রস্তুত হইয়া লইল, সূর্য তখন গ্রামের বাঁশবনগুলির পশ্চাতে অস্ত গিয়াছে। জাহাজ সেদিনকার মতো স্টেশন-ঘাটে নোঙর ফেলিয়াছে।
আজ কমলার রাত্রের রন্ধনব্যাপার তেমন বেশি নহে। সকালের অনেক তরকারি এ বেলা কাজে লাগিবে। এমন সময় রমেশ আসিয়া কহিল, মধ্যাহ্নে আজ গুরুভোজন হইয়াছে, এ বেলা সে আহার করিবে না।
কমলা বিমর্ষ হইয়া কহিল, “কিছু খাইবে না? শুধু কেবল মাছ-ভাজা দিয়া— ”
রমেশ সংক্ষেপে কহিল, “না, মাছ-ভাজা থাক্।” বলিয়া চলিয়া গেল।
কমলা তখন উমেশের পাতে সমস্ত মাছ-ভাজা ও চচ্চড়ি উজাড় করিয়া ঢালিয়া দিল। উমেশ কহিল, “তোমার জন্য কিছু রাখিলে না?”
সে কহিল, “আমার খাওয়া হইয়া গেছে।”
এইরূপে কমলার এই ভাসমান ক্ষুদ্র সংসারের একদিনের সমস্ত কর্তব্য সম্পন্ন হইয়া গেল।
জ্যোৎস্না তখন জলে স্থলে ফুটিয়া উঠিয়াছে। তীরে গ্রাম নাই, ধানের খেতের ঘন-কোমল সুবিস্তীর্ণ সবুজ জনশূন্যতার উপরে নিঃশব্দ শুভরাত্রি বিরহিণীর মতো জাগিয়া রহিয়াছে।