সেকেণ্ড্ক্লাসে যাত্রী কেহ ছিল না। কমলা মাথায় গায়ে একটা র্যাপার জড়াইয়া উমেশের কাছে গিয়া কহিল, “সেগুলো সব ফেলিয়া দিয়াছিস নাকি?”
উমেশ কহিল, “ফেলিতে যাইব কেন? এই ঘরের মধ্যেই সব রাখিয়াছি।”
কমলা রাগিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, “কিন্তু তুই ভারি অন্যায় করিয়াছিস। আর কখনো এমন কাজ করিস নে। দেখ্ দেখি স্টীমার যদি চলিয়া যাইত!”
এই বলিয়া ঘরের মধ্যে গিয়া কমলা উদ্ধতস্বরে কহিল, “আন্, বঁটি আন্।”
উমেশ বঁটি আনিয়া দিল। কমলা আগে উমেশের আহৃত তরকারি কুটিতে প্রবৃত্ত হইল।
উমেশ। মা, এই শাকগুলার সঙ্গে সর্ষেবাটা খুব চমৎকার হয়।
কমলা ক্রুদ্ধস্বরে কহিল, “আচ্ছা, তবে সর্ষে বাট্।”
এমনি করিয়া উমেশ যাহাতে প্রশ্রয় না পায়, কমলা সেই সতর্কতা অবলম্বন করিল। বিশেষ গম্ভীরমুখে তাহার শাক, তাহার তরকারি, তাহার বেগুন কুটিয়া রান্না চড়াইয়া দিল।
হায়, এই গৃহচ্যুত ছেলেটাকে প্রশ্রয় না দিয়াই বা কমলা থাকে কী করিয়া? শাক-চুরির গুরুত্ব যে কতখানি তাহা কমলা ঠিক বোঝে না; কিন্তু নিরাশ্রয় ছেলের নির্ভরলালসা যে কত একান্ত তাহা তো সে বোঝে। ঐ-যে কমলাকে একটুখানি খুশি করিবার জন্য এই লক্ষ্মীছাড়া বালক কাল হইতে এই কয়েকটা শাক-সংগ্রহের অবসর খুঁজিয়া বেড়াইতেছিল। আর-একটু হইলেই স্টীমার হইতে ভ্রষ্ট হইয়াছিল, ইহার করুণা কি কমলাকে স্পর্শ না করিয়া থাকিতে পারে?
কমলা কহিল, “উমেশ, তোর জন্যে কালকের সেই দই কিছু বাকি আছে, তোকে আজ আবার দই খাওয়াইব, কিন্তু খবরদার, এমন কাজ আর কখনো করিস নে।”
উমেশ অত্যন্ত দুঃখিত হইয়া কহিল, “মা, তবে সে দই তুমি কাল খাও নাই?”
কমলা কহিল, “তোর মতো দইয়ের উপর আমার অত লোভ নাই। কিন্তু উমেশ, সব তো হইল, মাছের জোগাড় কি হইবে? মাছ না পাইলে বাবুকে খাইতে দিব কী?”
উমেশ। মাছের জোগাড় করিতে পারি মা, কিন্তু সেটা তো বিনি পয়সায় হইবার জো নাই।
কমলা পুনরায় শাসনকার্যে প্রবৃত্ত হইল। তাহার সুন্দর দুটি ভ্রূ কুঞ্চিত করিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, “উমেশ, তোর মতো নির্বোধ আমি তো দেখি নাই। আমি কি তোকে বিনি পয়সায় জিনিস সংগ্রহ করিতে বলিয়াছি?”
গতকল্য উমেশের মনে কী করিয়া একটা ধারণা হইয়া গেছে যে, কমলা রমেশের কাছ হইতে টাকা আদায় করাটা সহজ মনে করে না। তা ছাড়া, সবসুদ্ধ জড়াইয়া রমেশকে তাহার ভালো লাগে নাই। এইজন্য রমেশের অপেক্ষা না রাখিয়া, কেবল সে এবং কমলা, এই দুই নিরুপায়ে মিলিয়া কী উপায়ে সংসার চালাইতে পারে তাহার গুটিকতক সহজ কৌশল সে মনে মনে উদ্ভাবন করিতেছিল। শাক-বেগুন-কাঁচকলা সম্বন্ধে সে একপ্রকার নিশ্চিন্ত হইয়াছিল, কিন্তু মাছটার বিষয়ে এখনো সে যুক্তি স্থির করিতে পারে নাই। পৃথিবীতে নিঃস্বার্থ ভক্তির জোরে সামান্য দই-মাছ পর্যন্ত জোটানো যায় না, পয়সা চাই; সুতরাং কমলার এই অকিঞ্চন ভক্ত-বালকটার পক্ষে পৃথিবী সহজ জায়গা নহে।
উমেশ কিছু কাতর হইয়া কহিল, “মা, যদি বাবুকে বলিয়া কোনোমতে গণ্ডা-পাঁচেক পয়সা জোগাড় করিতে পার, তবে একটা বড়ো রুই আনিতে পারি।”