কমলা কহিল, “তুমি আগে খাও!”
এইটুকু ব্যাপার, বেশি-কিছু নয়, কিন্তু রমেশের বর্তমান অবস্থায় এই হৃদয়ের কোমল আভাসটুকু তাহার বক্ষের ভিতরকার অশ্রু-উৎসে গিয়া যেন ঘা দিল। রমেশ কোনো কথা না বলিয়া জোর করিয়া ফল খাইতে লাগিল।
খাওয়ার পালা সাঙ্গ হইলে রমেশ কহিল, “কমলা, আজ রাত্রে আমরা দেশে যাইব।”
কমলা চোখ নিচু, মুখ বিষণ্ন করিয়া কহিল, “সেখানে আমার ভালো লাগে না।”
রমেশ। ইস্কুলে থাকিতে তোমার ভালো লাগে?
কমলা। না, আমাকে ইস্কুলে পাঠাইয়ো না। আমার লজ্জা করে। মেয়েরা আমাকে কেবল তোমার কথা
জিজ্ঞাসা করে।
রমেশ। তুমি কী বল?
কমলা। আমি কিছুই বলিতে পারি না। তাহারা জিজ্ঞাসা করিত, তুমি কেন আমাকে ছুটির সময়ে ইস্কুলে রাখিতে চাহিয়াছ— আমি—
কমলা কথা শেষ করিতে পারিল না। তাহার হৃদয়ের ক্ষতস্থানে আবার ব্যথা বাজিয়া উঠিল।
রমেশ। তুমি কেন বলিলে না, তিনি আমার কেহই হন না। কমলা রাগ করিয়া রমেশের মুখের দিকে কুটিল কটাক্ষে চাহিল— কহিল, “যাও!”
আবার রমেশ মনে মনে ভাবিতে লাগিল কী করা যাইবে? এ দিকে রমেশের বুকের ভিতরে বরাবর একটা চাপা বেদনা কীটের মতো যেন গহ্বর খনন করিয়া বাহির হইয়া আসিবার চেষ্টা করিতেছিল। এতক্ষণে যোগেন্দ্র হেমনলিনীকে কী বলিল, হেমনলিনী কী মনে করিতেছে, প্রকৃত অবস্থা কেমন করিয়া হেমনলিনীকে বুঝাইবে, হেমনলিনীর সহিত চিরকালের জন্য যদি তাহাকে বিচ্ছিন্ন হইতে হয়, তবে জীবন বহন করিবে কী করিয়া— এই-সকল জ্বালাময় প্রশ্ন ভিতরে ভিতরে জমা হইয়া উঠিতেছিল, অথচ ভালো করিয়া তাহা আলোচনা করিবার অবসর রমেশ পাইতেছিল না। রমেশ এটুকু বুঝিয়াছিল যে, কমলার সহিত রমেশের সম্বন্ধ কলিকাতায় তাহার বন্ধু ও শত্রুমণ্ডলীর মধ্যে তীব্র আলোচনার বিষয় হইয়া উঠিল। রমেশ যে কমলার স্বামী, এই গোলমালে সেই জনশ্রুতি যথেষ্ট ব্যাপ্ত হইতে থাকিবে। এ সময়ে রমেশের পক্ষে কমলাকে লইয়া আর এক দিনও কলিকাতায় থাকা সংগত হইবে না।
অন্যমনস্ক রমেশের এই চিন্তার মাঝখানে হঠাৎ কমলা তাহার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “তুমি কী ভাবিতেছ? তুমি যদি দেশে থাকিতে চাও, আমি সেইখানেই থাকিব।”
বালিকার মুখে এই আত্মসংযমের কথা শুনিয়া রমেশের বুকে আবার ঘা লাগিল; আবার সে ভাবিল কী করা যাইবে? পুনর্বার সে অন্যমনস্ক হইয়া ভাবিতে ভাবিতে নিরুত্তরে কমলার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
কমলা মুখ গম্ভীর করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা, আমি ছুটির সময়ে ইস্কুলে থাকিতে চাহি নাই বলিয়া তুমি রাগ করিয়াছ? সত্য করিয়া বলো।”
রমেশ কহিল, “সত্য করিয়াই বলিতেছি, তোমার উপরে রাগ করি নাই, আমি নিজের উপরেই রাগ করিয়াছি।”
রমেশ ভাবনার জাল হইতে নিজেকে জোর করিয়া ছাড়াইয়া লইয়া কমলার সহিত আলাপ করিতে প্রবৃত্ত হইল। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা, কমলা, ইস্কুলে এতদিন কী শিখিলে বলো দেখি।”
কমলা অত্যন্ত উৎসাহের সহিত নিজের শিক্ষার হিসাব দিতে লাগিল। সম্প্রতি পৃথিবীর গোলাকৃতির কথা তাহার অগোচর নাই জানাইয়া যখন সে রমেশকে চমৎকৃত করিয়া দিবার চেষ্টা করিল, রমেশ গম্ভীরমুখে ভূমণ্ডলের গোলত্বে সন্দেহ প্রকাশ করিল। কহিল,