যোগেন্দ্র উত্তেজিত হইয়া কহিল, “তোমরা জান না সে কোথায় যাইবে, তাহার বেহারা জানে না সে কোথায় গেছে, এ কিরকম লুকোচুরি ব্যাপার চলিতেছে? আমার কাছে এ তো কিছুই ভালো ঠেকিতেছে না। বাবা, তুমি এমন নিশ্চিন্ত আছ কী করিয়া?”
অন্নদাবাবু এই ভর্ৎসনায় হঠাৎ অত্যন্ত চিন্তিত হইবার চেষ্টা করিলেন। গম্ভীর মুখ করিয়া কহিলেন, “তাই তো, এ-সব কী?”
কাণ্ডজ্ঞানহীন রমেশ অনায়াসে কাল রাত্রে অন্নদাবাবুর কাছে বিদায় লইয়া যাইতে পারিত। কিন্তু সে কথা তাহার মনে উদয়ও হয় নাই। ঐ-যে সে ‘বিশেষ প্রয়োজন আছে’ বলিয়া রাখিয়াছে, তাহার মধ্যেই তাহার সকল কথা বলা হইয়া গেছে এইরূপ রমেশের ধারণা। ঐ এক কথাতেই আপাতত সকল রকমের ছুটি পাইয়াছে জানিয়া সে তাহার উপস্থিত কর্তব্যসাধনে বিব্রত হইয়া বেড়াইতেছে।
যোগেন্দ্র। হেমনলিনী কোথায়?
অন্নদাবাবু। সে আজ সকাল-সকাল চা খাইয়া উপরেই গেছে।
যোগেন্দ্র কহিল, “রমেশের এই-সমস্ত অদ্ভুত আচরণে বেচারা বোধ হয় অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া আছে— সেইজন্য সে আমার সঙ্গে দেখা হইবার ভয়ে পালাইয়া রহিয়াছে।”
সংকুচিত ও ব্যথিত হেমনলিনীকে আশ্বাস দিবার জন্য যোগেন্দ্র উপরে গেল। হেমনলিনী তাহাদের বড়ো ঘরে চৌকির উপরে চুপ করিয়া একা বসিয়া ছিল। যোগেন্দ্রের পদশব্দ শুনিয়াই সে তাড়াতাড়ি একটা বই টানিয়া লইয়া পড়িবার ভান করিল। যোগেন্দ্র ঘরে আসিতেই বই রাখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া হাসিমুখে কহিল, “এই-যে দাদা, কখন এলে? তোমাকে তো তেমন বিশেষ ভালো দেখাইতেছে না।”
যোগেন্দ্র চৌকিতে বসিয়া-পড়িয়া কহিল, “ভালো দেখাইবার তো কথা নয়। আমি সব কথা শুনিয়াছি হেম! কিন্তু এ সম্বন্ধে তুমি কোনো চিন্তা করিয়ো না। আমি ছিলাম না বলিয়াই এইরকম গোলমাল ঘটিতে পারিয়াছে। আমি সমস্ত ঠিক করিয়া দিব। আচ্ছা হেম, রমেশ তোমাকে কোনো কারণ বলে নাই?”
হেমনলিনী মুশকিলে পড়িল। রমেশ সম্বন্ধে এই-সকল সন্দিগ্ধ আলোচনা তাহার পক্ষে অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে। রমেশ তাহাকে বিবাহদিন পিছাইবার কোনো কারণ বলে নাই, এ কথা যোগেন্দ্রকে বলিতে তাহার ইচ্ছা নাই, অথচ মিথ্যা বলাও তাহার পক্ষে অসম্ভব। হেমনলিনী কহিল, “তিনি আমাকে কারণ বলিতে প্রস্তুত ছিলেন, আমি শোনা দরকার মনে করি নাই।”
যোগেন্দ্র মনে করিল, ইহা গুরুতর অভিমানের কথা এবং এরূপ অভিমান সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কহিল, “আচ্ছা, তুমি কিছুই ভয় করিয়ো না, ‘কারণ’ আমি আজই বাহির করিয়া আনিব।”
হেমনলিনী কোলের বইখানার পাতা অনাবশ্যক উল্টাইতে উল্টাইতে কহিল, “দাদা, আমি ভয় কিছুই করি না। ‘কারণ’ বাহির করিবার জন্য তুমি তাঁহাকে পীড়াপীড়ি কর, এমন আমার ইচ্ছা নয়।”
যোগেন্দ্র ভাবিল, ইহাও অভিমানের কথা। কহিল, “আচ্ছা, সে তোমাকে কিছুই ভাবিতে হইবে না।” বলিয়া তখনই চলিয়া যাইতে উদ্যত হইল।
হেমনলিনী তখনই চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া কহিল, “না দাদা, এ কথা লইয়া তুমি তাঁহার সঙ্গে আলোচনা করিতে যাইতে পারিবে না। তোমরা তাঁহাকে যাহাই মনে কর-না কেন, আমি তাঁহাকে কিছুমাত্র সন্দেহ করি না।”
তখন যোগেন্দ্রের হঠাৎ মনে হইল, এ তো অভিমানের মতো শুনাইতেছে না। তখন স্নেহমিশ্রিত করুণায় তাহার মনে মনে হাসি পাইল। ভাবিল, ইহাদের সংসারের জ্ঞান কিছুই নাই; এ দিকে পড়াশুনা এত করিয়াছে, পৃথিবীর খোঁজখবরও অনেক রাখে,