রমেশ প্রফুল্লচিত্তে সংসারের ছোটো-বড়ো আঘাত-সংঘাত বুক পাতিয়া লইবার জন্য চলিয়া গেল।
অন্নদাবাবু রমেশকে পুনরায় গৃহে প্রবেশ করিতে দেখিয়া উদ্বিগ্নভাবে তাহার মুখের দিকে চাহিলেন।
রমেশ কহিল, “নিমন্ত্রণের ফর্দটা যদি আমার হাতে দেন, তবে দিনপরিবর্তনের চিঠিগুলি আজই রওনা করিয়া দিতে পারি।”
অন্নদাবাবু কহিলেন, “তবে দিনপরিবর্তনই স্থির রহিল?”
রমেশ কহিল, “হাঁ, অন্য উপায় আর কিছুই দেখি না।”
অন্নদাবাবু কহিলেন, “দেখো বাপু, তবে আমি ইহার মধ্যে নাই। যাহা-কিছু বন্দোবস্ত করিবার, সে তুমিই করিয়ো। আমি লোক হাসাইতে পারিব না। বিবাহ-ব্যাপারটাকে যদি নিজের মর্জি অনুসারে ছেলেখেলা করিয়া তোল, তবে আমার মতো বয়সের লোকের ইহার মধ্যে না থাকাই ভালো। এই লও তোমার নিমন্ত্রণের ফর্দ। ইতিমধ্যে আমি কতকগুলা টাকা খরচ করিয়া ফেলিয়াছি, তাহার অনেকটাই নষ্ট হইবে। এমনি করিয়া বার বার টাকা জলে ফেলিয়া দিতে পারি এমন সংগতি আমার নাই।”
রমেশ সমস্ত ব্যয় ও ব্যবস্থার ভার নিজের স্কন্ধে লইতেই প্রস্তুত হইল। সে উঠিবার উপক্রম করিতেছে, এমন সময় অন্নদাবাবু কহিলেন, “রমেশ, বিবাহের পরে তুমি কোথায় প্র্যাক্টিস করিবে, কিছু স্থির করিয়াছ? কলিকাতায় নয়?”
রমেশ কহিল, “না। পশ্চিমে একটা ভালো জায়গার সন্ধান করিতেছি।”
অন্নদা। সেই ভালো, পশ্চিমই ভালো। এটোয়া তো মন্দ জায়গা নয়। সেখানকার জল হজমের পক্ষে অতি উত্তম— আমি সেখানে মাসখানেক ছিলাম— সেই এক মাসে আমার আহারের পরিমাণ ডবল বাড়িয়া গিয়াছিল। দেখো বাপু, সংসারে আমার ঐ একটিমাত্র মেয়ে— আমি সর্বদা উহার কাছে কাছে না থাকিলে সেও সুখী হইবে না, আমিও নিশ্চিন্ত হইতে পারিব না। তাই আমার ইচ্ছা— তোমাকে একটা স্বাস্থ্যকর জায়গা বাছিয়া লইতে হইবে।
অন্নদাবাবু রমেশের একটা অপরাধের অবকাশ পাইয়া সেই সুযোগে নিজের বড়ো বড়ো দাবিগুলা উপস্থিত করিতে আরম্ভ করিলেন। সে সময়ে রমেশকে তিনি যদি এটোয়া না বলিয়া গারো বা চেরাপুঞ্জির কথা বলিতেন, তবে তৎক্ষণাৎ সে রাজি হইত। সে কহিল, “যে আজ্ঞা, আমি এটোয়াতেই প্র্যাকটিস করিব।” এই বলিয়া রমেশ নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যানের কার্যভার লইয়া প্রস্থান করিল।
অনতিকাল পরে অক্ষয় ঘরে ঢুকিতেই অন্নদাবাবু কহিলেন, “রমেশ তাহার বিবাহের দিন এক সপ্তাহ পিছাইয়া দিয়াছে।”
অক্ষয়। না না, আপনি বলেন কী! সে কি কখনো হইতে পারে? পরশু যে বিবাহ।
অন্নদা। হইতে তো না পারাই উচিত ছিল— সাধারণ লোকের তো এমনতরো হয় না। কিন্তু আজকাল তোমাদের যে-রকম কাণ্ড দেখিতেছি, সবই সম্ভব।
অক্ষয় অত্যন্ত মুখ গম্ভীর করিয়া আড়ম্বর-সহকারে চিন্তা করিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে কহিল, “আপনারা যাহাকে একবার সৎপাত্র বলিয়া ঠাওরাইয়াছেন, তাহার সম্বন্ধে দুটি চক্ষু বুজিয়া থাকেন। মেয়েকে যাহার হাতে চিরদিনের মতো সমর্পণ করিতে যাইতেছেন, ভালো করিয়া তাহার সম্বন্ধে খোঁজখবর রাখা উচিত। হোক-না কেন সে স্বর্গের দেবতা, তবু সাবধানের বিনাশ নাই।”
অন্নদা। রমেশের মতো ছেলেকেও যদি সন্দেহ করিয়া চলিতে হয়, তবে তো সংসারে কাহারো সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ রাখা অসম্ভব হইয়া পড়ে।
অক্ষয়। আচ্ছা, এই-যে দিন পিছাইয়া দিতেছেন, রমেশবাবু তাহার কারণ কিছু বলিয়াছেন?