হেমনলিনী হাসিয়া কহিল, “বাবা, ঐ পিল খাওয়াও নাই, তোমার এমন আলাপী কেহ দেখি না— কিন্তু তাহাদের এমন কী উপকার হইয়াছে?”
অন্নদা। অনিষ্ট তো হয় নাই। আমি যে নিজে পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি— এ পর্যন্ত যতরকম পিল খাইয়াছি, এইটেই সব চেয়ে উপকারী।
হেমনলিনী। বাবা, যখন তুমি একটা নূতন পিল খাইতে আরম্ভ কর, তখনি কিছুদিন তাহার অশেষ গুণ দেখিতে পাও—
অন্নদা। তোমরা কিছুই বিশ্বাস কর না— আচ্ছা, অক্ষয়কে জিজ্ঞাসা করিয়ো দেখি, আমার চিকিৎসায় সে উপকার পাইয়াছে কি না।
সেই প্রামাণিক সাক্ষীকে তলবের ভয়ে হেমনলিনীকে নিরুত্তর হইতে হইল। কিন্তু সাক্ষী আপনি আসিয়া হাজির হইল। আসিয়াই অন্নদাবাবুকে কহিল, “অন্নদাবাবু, আপনার সেই পিল আমাকে আর-একটি দিতে হইবে। বড়ো উপকার হইয়াছে। আজ শরীর এমনি হালকা বোধ হইতেছে!”
অন্নদাবাবু সগর্বে তাঁহার কন্যার মুখের দিকে তাকাইলেন।
পিল খাওয়ার পর অন্নদাবাবু অক্ষয়কে শীঘ্র ছাড়িতে চাহিলেন না। অক্ষয়ও যাইবার জন্য বিশেষ ত্বরা প্রকাশ না করিয়া মাঝে মাঝে রমেশের মুখের দিকে কটাক্ষপাত করিতে লাগিল। রমেশের চোখে সহজে কিছু পড়ে না— কিন্তু আজ অক্ষয়ের এই কটাক্ষগুলি তাহার চোখ এড়াইল না। ইহাতে তাহাকে বার বার উদ্বেজিত করিয়া তুলিতে লাগিল।
পশ্চিমে বেড়াইতে যাইবার সময় নিকটবর্তী হইয়া উঠিয়াছে— মনে মনে তাহারই আলোচনায় হেমনলিনীর চিত্ত আজ বিশেষ প্রফুল্ল ছিল। সে ঠিক করিয়া রাখিয়াছিল, আজ রমেশবাবু আসিলে ছুটিযাপন সম্বন্ধে তাঁহার সঙ্গে নানাপ্রকার পরামর্শ করিবে। সেখানে নিভৃতে কী কী বই পড়িয়া শেষ করিতে হইবে, দুজনে মিলিয়া তাহার একটা তালিকা করিবার কথা ছিল। স্থির ছিল, রমেশ আজ সকাল-সকাল আসিবে, কেননা, চায়ের সময়ে অক্ষয় কিংবা কেহ-না-কেহ আসিয়া পড়ে, তখন মন্ত্রণা করিবার অবসর পাওয়া যায় না।
কিন্তু আজ রমেশ অন্য দিনের চেয়েও দেরি করিয়া আসিয়াছে। মুখের ভাবও তাহার অত্যন্ত চিন্তাযুক্ত। ইহাতে হেমনলিনীর উৎসাহে অনেকটা আঘাত পড়িল। কোনো-এক সুযোগে সে রমেশকে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি আজ বড়ো যে দেরি করিয়া আসিলেন?”
রমেশ অন্যমনস্কভাবে একটু চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “হাঁ, আজকে একটু দেরি হইয়া গেছে বটে।”
হেমনলিনী আজ তাড়াতাড়ি করিয়া কত সকাল-সকাল চুল বাঁধিয়া লইয়াছে। চুল-বাঁধা কাপড়-ছাড়ার পরে সে আজ কতবার ঘড়ির দিকে তাকাইয়াছে— অনেকক্ষণ পর্যন্ত মনে করিয়াছে তাহার ঘড়িটা ভুল চলিতেছে, এখনো বেশি দেরি হয় নাই। যখন এই বিশ্বাস রক্ষা করা একেবারে অসাধ্য হইয়া উঠিল তখন সে জানলার কাছে বসিয়া একটা সেলাই লইয়া কোনোমতে মনের অধৈর্য শান্ত রাখিবার চেষ্টা করিয়াছে। তাহার পরে রমেশ মুখ গম্ভীর করিয়া আসিল— কী কারণে দেরি হইয়াছে, তাহার কোনোপ্রকার জবাবদিহি করিল না— আজ সকাল-সকাল আসিবার যেন কোনো শর্তই ছিল না।