“অজায়গায় যদি এসে পড়ি সেখানকারও দায়িত্ব আছে শেষ পর্যন্ত।”
এলা অতীনের গলা জড়িয়ে ধরে বললে, “ফিরে এস, অন্তু। এত বছর ধরে যে-বিশ্বাসের মধ্যে বাসা নিয়েছিলুম তার ভিত তুমি ভেঙে দিয়েছ। আজ আছি ভেসে-চলা ভাঙা নৌকো আঁকড়িয়ে। আমাকেও উদ্ধার করে নিয়ে যাও। – অমন চুপ করে বসে থেকো না, বলো অন্তু, একটা কথা বলো। এখনই তুমি হুকুম করো আমি ভাঙব পণ। ভুল করেছি আমি। আমাকে মাপ করো।”
“উপায় নেই।”
“কেন উপায় নেই? নিশ্চয় আছে।”
“তীর লক্ষ্য হারাতে পারে তূণে ফিরতে পারে না।”
“আমি স্বয়ংবরা, আমাকে বিয়ে করো অন্তু। আর সময় নষ্ট করতে পারব না– গান্ধর্ব বিবাহ হোক, সহধর্মিণী করে নিয়ে যাও তোমার পথে।”
“বিপদের পথ হলে নিয়ে যেতুম সঙ্গে। কিন্তু যেখানে ধর্মনষ্ট হয়েছে সেখানে তোমাকে সহধর্মিণী করতে পারব না।– থাক্ থাক্, ও-সব কথা থাক্। এ-জীবনের নৌকোডুবির অবসানে কিছু সত্য এখনও বাকি আছে। তারই কথাটা শুনি তোমার মুখে।”
“কী বলব?”
“বলো, তুমি ভালোবেসেছ।”
“হাঁ বেসেছি।”
“বলো, আমি তোমাকে ভালোবেসেছি সে-কথা তোমার মনে থাকবে আমি যখন থাকব না তখনও।”
এলা নিরুত্তরে চুপ করে বসে রইল, জল পড়তে লাগল দুই চোখে। অনেকক্ষণ পরে বাষ্পরুদ্ধ গলায়
বললে, “আবার বলছি, অন্তু, কিছু নাও আমার হাত থেকে– নাও এই আমার গলার হার।”
এই বলে পায়ের উপর রাখল হার।
“কিছুতেই না।”
“কেন, অভিমান?”
“হাঁ, অভিমান। এমন দিন ছিল তখন যদি দিতে, পরতুম গলায়– আজ দিলে পকেটে, অন্নাভাবের গর্তটার মধ্যে। ভিক্ষে নেব না তোমার কাছে।”
এলা অতীনের পায়ের কাছে লুটিয়ে বললে, “নাও আমাকে তোমার সঙ্গিনী করে।”
“লোভ দেখিয়ো না, এলা। অনেকবার বলেছি আমার পথ তোমার নয়।”
“তবে সে-পথ তোমারও নয়। ফিরে এসো, ফিরে এসো।”
“পথ আমার নয়, আমিই পথের। গলার ফাঁসকে গলার গয়না কেউ বলে না।”
“অন্তু, নিশ্চয় জেনো, তুমি চলে গেলে একমুহূর্ত আমি বাঁচব না। তুমি ছাড়া আর কেউ নেই আমার, এ কথায় আজ যদি বা সন্দেহ কর, একান্ত মনে আশা করি মৃত্যুর পরে সে সন্দেহ সম্পূর্ণ ঘোচাবার একটা কোনো রাস্তা কোথাও আছে।”
হঠাৎ অতীন লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। তীরের মতো তীক্ষ্ম হুইস্লের শব্দ এল দূর থেকে। চমকে বলে উঠল, “চললুম।”
এলা তাকে জড়িয়ে ধরলে, বললে, “আর-একটু থাকো।”
“না।”
“কোথায় যাচ্ছ?”