রঘুপতি অস্থিরভাবে কুটিরের দাওয়ায় বেড়াইতে লাগিলেন। এইরূপে রাত্রি অনেক হইল; ক্রমাগত বৃষ্টি পড়িতে লাগিল। অবশেষে রঘুপতি জয়সিংহের পিঠে হাত দিয়া কোমলস্বরে কহিলেন, “বৎস, শয়ন করিতে যাও, রাত্রি অনেক হইল।”
জয়সিংহ রঘুপতির স্নেহের স্বরে বিচলিত হইয়া কহিলেন, “প্রভু আগে শয়ন করিতে যান, তার পরে আমি যাইব।”
রঘুপতি কহিলেন, “আমার বিলম্ব আছে। দেখো পুত্র, তোমার প্রতি আমি আজ কঠোর ব্যবহার করিয়াছি, কিছু মনে করিয়ো না। আমার মন ভালো ছিল না। সবিশেষ বৃত্তান্ত তোমাকে কাল প্রভাতে বলিব। আজ তুমি শয়ন করোগে।”
জয়সিংহ কহিলেন, “যে আজ্ঞে।”
বলিয়া শয়ন করিতে গেলেন। রঘুপতি সমস্ত রাত বেড়াইতে লাগিলেন।
প্রভাতে জয়সিংহ গুরুকে প্রণাম করিয়া দাঁড়াইলেন। রঘুপতি কহিলেন, “জয়সিংহ, মায়ের বলি বন্ধ হইয়াছে।”
জয়সিংহ বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “সেকি কথা প্রভু!”
রঘুপতি। রাজার এইরূপ আদেশ।
জয়সিংহ। কোন্ রাজার?
রঘুপতি বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “এখানে রাজা আবার কয় গণ্ডা আছে? মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য আদেশ করিয়াছেন, মন্দিরে জীববলি হইতে পারিবে না।”
জয়সিংহ। নরবলি?
রঘুপতি। আঃ, কী উৎপাত! আমি বলিতেছি জীববলি, তুমি শুনিতেছ নরবলি।
জয়সিংহ। কোনো জীববলিই হইতে পারিবে না?
রঘুপতি। না।
জয়সিংহ। মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য এইরূপ আদেশ করিয়াছেন?
রঘুপতি। হাঁ গো, এক কথা কতবার বলিব!
জয়সিংহ অনেকক্ষণ কিছুই বলিলেন না, কেবল আপন মনে বলিতে লাগিলেন, ‘মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য!’ গোবিন্দমাণিক্যকে জয়সিংহ ছেলেবেলা হইতে দেবতা বলিয়া জানিতেন। আকাশের পূর্ণচন্দ্রের প্রতি শিশুদের যেমন একপ্রকার আসক্তি আছে, গোবিন্দমাণিক্যের প্রতি জয়সিংহের সেইরূপ মনের ভাব ছিল। গোবিন্দমাণিক্যের প্রশান্ত সুন্দর মুখ দেখিয়া জয়সিংহ প্রাণ বিসর্জন করিতে পারিতেন।
রঘুপতি কহিলেন, “ইহার একটা তো প্রতিবিধান করিতে হইবে।”
জয়সিংহ কহিলেন, “তা অবশ্য। আমি মহারাজের কাছে যাই, তাঁহাকে মিনতি করিয়া বলি– ”
রঘুপতি। সে চেষ্টা বৃথা।
জয়সিংহ। তবে কী করিতে হইবে?
রঘুপতি কিয়ৎক্ষণ ভাবিয়া বলিলেন, “সে কাল বলিব। কাল তুমি প্রভাতে কুমার নক্ষত্ররায়ের নিকটে গিয়া তাঁহাকে গোপনে আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে অনুরোধ করিবে।”