কাল প্রায়শ্চিত্তসভা বসিবে, আজ রাত্রি হইতেই গোরা বাগানে গিয়া বাস করিবে এইরূপ স্থির আছে। যখন সে যাত্রা করিবার উপক্রম করিতেছে এমন সময় হরিমোহিনী আসিয়া উপস্থিত। তাঁহাকে দেখিয়া গোরা প্রসন্নতা অনুভব করিল না। গোরা কহিল, “আপনি এসেছেন— আমাকে যে এখনই বেরোতে হবে— মাও তো কয়েক দিন বাড়িতে নেই। যদি তাঁর সঙ্গে প্রয়োজন থাকে তা হলে—”
হরিমোহিনী কহিলেন, “না বাবা, আমি তোমার কাছেই এসেছি— একটু তোমাকে বসতেই হবে— বেশিক্ষণ না।”
গোরা বসিল। হরিমোহিনী সুচরিতার কথা পাড়িলেন। কহিলেন, গোরার শিক্ষাগুণে তাহার বিস্তর উপকার হইয়াছে। এমন-কি, সে আজকাল যার-তার হাতের ছোঁওয়া জল খায় না এবং সকল দিকেই তাহার সুমতি জন্মিয়াছে—‘বাবা, ওর জন্যেই কি আমার কম ভাবনা ছিল! ওকে তুমি পথে এনে আমার কী উপকার করেছ সে আমি তোমাকে এক মুখে বলতে পারি নে। ভগবান তোমাকে রাজরাজেশ্বর করুন। তোমার কুলমানের যোগ্য একটি লক্ষ্মী মেয়ে ভালো ঘর থেকে বিয়ে করে আনো, তোমার ঘর উজ্জ্বল হোক, ধনেপুত্রে লক্ষ্মীলাভ হোক।’
তাহার পরে কথা পাড়িলেন, সুচরিতার বয়স হইয়াছে, বিবাহ করিতে তাহার আর এক মুহূর্ত বিলম্ব করা উচিত নয়, হিন্দুঘরে থাকিলে এতদিনে সন্তানের দ্বারা তাহার কোল ভরিয়া উঠিত। বিবাহে বিলম্ব করায় যে কতবড়ো অবৈধ কাজ হইয়াছে সে সম্বন্ধে গোরা নিশ্চয়ই তাহার সঙ্গে একমত হইবেন। হরিমোহিনী দীর্ঘকাল ধরিয়া সুচরিতার বিবাহসমস্যা সম্বন্ধে অসহ্য উদ্বেগ ভোগ করিয়া অবশেষে বহু সাধ্যসাধনা অনুনয়বিনয়ে তাহার দেবর কৈলাসকে রাজি করিয়া কলিকাতায় আনিয়াছেন। যে-সমস্ত গুরুতর বাধাবিঘ্নের আশঙ্কা করিয়াছিলেন তাহা সমস্তই ঈশ্বরেচ্ছায় কাটিয়া গিয়াছে। সমস্তই স্থির, বরপক্ষে এক পয়সা পণ পর্যন্ত লইবে না এবং সুচরিতার পূর্ব-ইতিহাস লইয়াও কোনো আপত্তি প্রকাশ করিবে না— হরিমোহিনী বিশেষ কৌশলে এই-সমস্ত সমাধান করিয়া দিয়াছেন— এমন সময়, শুনিলে লোকে আশ্চর্য হইবে, সুচরিতা একেবারে বাঁকিয়া দাঁড়াইয়াছে। কী তাহার মনের ভাব তিনি জানেন না; কেহ তাহাকে কিছু বুঝাইয়াছে কি না, আর-কারও দিকে তাহার মন পড়িয়াছে কি না, তাহা ভগবান জানেন।–
“কিন্তু বাপু, তোমাকে আমি খুলেই বলি, ও মেয়ে তোমার যোগ্য নয়। পাড়াগাঁয়ে ওর বিয়ে হলে ওর কথা কেউ জানতেই পারবে না; সে একরকম করে চলে যাবে। কিন্তু তোমরা শহরে থাক, ওকে যদি বিয়ে কর তা হলে শহরের লোকের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না।”
গোরা ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিয়া কহিল, “আপনি এ-সব কথা কী বলছেন! কে আপনাকে বলেছে যে, আমি তাঁকে বিবাহ করবার জন্যে তাঁর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে গেছি!”
হরিমোহিনী কহিলেন, “আমি কী করে জানব বাবা! কাগজে বেরিয়ে গেছে সেই শুনেই তো লজ্জায় মরছি।”
গোরা বুঝিল, হারানবাবু, অথবা তাঁহার দলের কেহ এই কথা লইয়া কাগজে আলোচনা করিয়াছে। গোরা মুষ্টি বদ্ধ করিয়া কহিল, “মিথ্যা কথা!”
হরিমোহিনী তাহার গর্জনশব্দে চমকিয়া উঠিয়া কহিলেন, “আমিও তো তাই জানি। এখন আমার একটি অনুরোধ তোমাকে রাখতেই হবে। একবার তুমি রাধারানীর কাছে চলো।”
গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “কেন?”
হরিমোহিনী কহিলেন, “তুমি তাকে একবার বুঝিয়ে বলবে।”