অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী
বাল্যকালে  আমার কাব্যালোচনার মস্ত একজন অনুকূল  সুহৃদ  জুটিয়াছিল।  ৺অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী
১  মহাশয় জ্যোতিদাদার সহপাঠী বন্ধু ছিলেন। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ.। সে সাহিত্যে তাঁহার যেমন ব্যুৎপত্তি তেমনি অনুরাগ  ছিল।  অপর  পক্ষে  বাংলা  সাহিত্যে  বৈষ্ণবপদকর্তা,  কবিকঙ্কণ,  রামপ্রসাদ,  ভারতচন্দ্র,  হরুঠাকুর, রামবসু,  নিধুবাবু,  শ্রীধর  কথক  প্রভৃতির  প্রতি  তাঁহার  অনুরাগের  সীমা  ছিল  না।  বাংলা  কত  উদ্ভট  গানই তাঁহার মুখস্থ ছিল। সে-গান সুরে বেসুরে যেমন করিয়া পারেন, একেবারে মরিয়া হইয়া গাহিয়া যাইতেন। সে-সম্বন্ধে শ্রোতারা আপত্তি করিলেও তাঁহার উৎসাহ অক্ষুণ্ন থাকিত। সঙ্গে সঙ্গে তাল বাজাইবার সম্বন্ধেও অন্তরে বাহিরে তাঁহার কোনো প্রকার বাধা ছিল না। টেবিল হউক, বই হউক, বৈধ অবৈধ যাহা-কিছু হাতের কাছে পাইতেন, তাহাকে অজস্র টপাটপ্ শব্দে ধ্বনিত করিয়া আসর গরম করিয়া তুলিতেন। আনন্দ উপভোগ করিবার শক্তি ইহার অসামান্য উদার ছিল। প্রাণ ভরিয়া রসগ্রহণ করিতে ইহার কোনো বাধা ছিল না এবং মন খুলিয়া গুণগান করিবার বেলায় ইনি কার্পণ্য করিতে জানিতেন না। গান এবং খণ্ডকাব্য লিখিতেও ইহার  ক্ষিপ্রতা অসামান্য ছিল। অথচ নিজের এই সকল রচনা সম্বন্ধে তাঁহার লেশমাত্র  মমত্ব  ছিল  না।  কত  ছিন্নপত্রে  তাঁহার  কত  পেন্সিলের  লেখা  ছড়াছড়ি  যাইত,  সে  দিকে  খেয়ালও করিতেন না, রচনা সম্বন্ধে তাঁহার ক্ষমতার যেমন প্রাচুর্য তেমনি ঔদাসীন্য ছিল। উদাসিনী নামে ইহার একখানি কাব্য তখনকার
২ বঙ্গদর্শনে যথেষ্ট প্রশংসা লাভ করিয়াছিল। ইহার অনেক গান লোককে গাহিতে শুনিয়াছি, কে যে তাহার রচয়িতা তাহা কেহ জানেও না।
সাহিত্যভোগের  অকৃত্রিম  উৎসাহ  সাহিত্যে  পাণ্ডিত্যের  চেয়ে  অনেক  বেশি  দুর্লভ।  অক্ষয়বাবুর  সেই অপর্যাপ্ত উৎসাহ আমাদের সাহিত্যবোধ শক্তিকে সচেতন করিয়া তুলিত।
সাহিত্যে যেমন তাঁর ঔদার্য বন্ধুত্বেও তেমনি। অপরিচিত সভায় তিনি ভাঙায় তোলা মাছের মতো ছিলেন কিন্তু পরিচিতদের মধ্যে তিনি বয়স বা বিদ্যাবুদ্ধির কোনো বাছবিচার করিতেন না। বালকদের দলে তিনি বালক ছিলেন, দাদাদের সভা হইতে যখন অনের রাত্রে বিদায় লইতেন তখন কতদিন আমি তাঁহাকে গ্রেফতার করিয়া আমাদের  ইস্কুলঘরে  টানিয়া  আনিয়াছি।  সেখানেও  রেড়ির  তেলের  মিট্মিটে  আলোতে  আমাদের  পড়িবার টেবিলের উপর বসিয়া সভা জমাইয়া তুলিতে তাঁহার কোনো কুন্ঠা ছিল না। এমনি করিয়া তাঁহার কাছে কত ইংরেজি কাব্যের উচ্ছ্বসিত ব্যাখ্যা শুনিয়াছি তাঁহাকে লইয়া কত তর্কবিতর্ক আলোচনা-সমালোচনা করিয়াছি। নিজের লেখা তাঁহাকে কত শুনাইয়াছি এবং সে লেখার মধ্যে যদি সামান্য কিছু গুণপনা থাকিত তবে তাহা লইয়া তাঁহার কাছে কত অপর্যাপ্ত প্রশংসালাভ করিয়াছি।