সুচরিতার মতো মেয়ের পক্ষে হিন্দুসমাজে প্রবেশের ন্যায় এতবড়ো দুরূহ ব্যাপারকে হরিমোহিনী নিতান্তই সহজ করিয়া আনিয়াছেন এরূপ তিনি আভাস দিলেন। এমন একটি সুযোগ একেবারে আসন্ন হইয়াছে যে, বড়ো বড়ো কুলীনের ঘরে নিমন্ত্রণের এক পঙ্ক্তিতে আহারের উপলক্ষে কেহ তাহাকে টুঁ শব্দ করিতে সাহস করিবে না।
ভূমিকা এই পর্যন্ত অগ্রসর হইতেই পাল্কি বাড়িতে আসিয়া পৌঁছিল। উভয়ে দ্বারের কাছে নামিয়া বাড়িতে প্রবেশ করিয়া উপরে যাইবার সময় সুচরিতা দেখিতে পাইল, দ্বারের পাশের ঘরে একটি অপরিচিত লোক বেহারাকে দিয়া প্রবল করতাড়ন-শব্দ-সহযোগে তৈল মর্দন করিতেছে। সে তাহাকে দেখিয়া কোনো সংকোচ মানিল না— বিশেষ কৌতূহলের সহিত তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিল।
উপরে গিয়া হরিমোহিনী তাঁহার দেবরের আগমন-সংবাদ সুচরিতাকে জানাইলেন। পূর্বের ভূমিকার সহিত মিলাইয়া লইয়া সুচরিতা এই ঘটনাটির অর্থ ঠিকমতই বুঝিল। হরিমোহিনী তাহাকে বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন, বাড়িতে অতিথি আসিয়াছে, এমন অবস্থায় তাহাকে ফেলিয়া আজই মধ্যাহ্নে চলিয়া যাওয়া তাহার পক্ষে ভদ্রাচার হইবে না।
সুচরিতা খুব জোরের সঙ্গে ঘাড় নাড়িয়া কহিল, “না মাসি, আমাকে যেতেই হবে।”
হরিমোহিনী কহিলেন, “তা বেশ তো, আজকের দিনটা থেকে তুমি কাল যেয়ো।”
সুচরিতা কহিল, “আমি এখনই স্নান করেই বাবার ওখানে খেতে যাব, সেখান থেকে ললিতার বাড়ি যাব।”
তখন হরিমোহিনী স্পষ্ট করিয়াই কহিলেন, “তোমাকেই যে দেখতে এসেছে।”
সুচরিতা মুখ রক্তিম করিয়া কহিল, “আমাকে দেখে লাভ কী?”
হরিমোহিনী কহিলেন, “শোনো একবার! এখনকার দিনে না দেখে কি এ-সব কাজ হবার জো আছে! সে বরঞ্চ সেকালে চলত। তোমার মেসো শুভদৃষ্টির পূর্বে আমাকে দেখেন নি।”
এই বলিয়াই এই স্পষ্ট ইঙ্গিতের উপরে তাড়াতাড়ি আরো কতকগুলা কথা চাপাইয়া দিলেন। বিবাহের পূর্বে কন্যা দেখিবার সময় তাঁহার পিতৃগৃহে সুবিখ্যাত রায়-পরিবার হইতে অনাথবন্ধু-নামধারী তাঁহাদের বংশের পুরাতন কর্মচারী ও ঠাকুরদাসী-নাম্নী প্রবীণা ঝি, দুইজন পাগড়ি-পরা দণ্ডধারী দরোয়ানকে লইয়া কিরূপে কন্যা দেখিতে আসিয়াছিল এবং সেদিন তাঁহার অভিভাবকদের মন কিরূপ উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিয়াছিল এবং রায়-বংশের এই-সকল অনুচরকে আহারে ও আদরে পরিতুষ্ট করিবার জন্য সেদিন তাঁহাদের বাড়িতে কিরূপ ব্যস্ততা পড়িয়া গিয়াছিল, তাহা বর্ণনা করিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন এবং কহিলেন— এখন দিনক্ষণ অন্যরকম পড়িয়াছে।
হরিমোহিনী কহিলেন, “বিশেষ কিছুই উৎপাত নেই, একবার কেবল পাঁচ মিনিটের জন্যে দেখে যাবে।”
সুচরিতা কহিল, “না।”
সে ‘না’ এতই প্রবল এবং স্পষ্ট যে হরিমোহিনীকে একটু হঠিতে হইল। তিনি কহিলেন, “আচ্ছা বেশ, তা নাই হল। দেখার তো কোনো দরকার নেই, তবে কৈলাস আজকালকার ছেলে, লেখাপড়া শিখেছে, তোমাদেরই মতো ও তো কিছুই মানে না, বলে ‘পাত্রী নিজের চক্ষে দেখব’। তা তোমরা সবার সামনেই বেরোও তাই বললুম, ‘দেখবে সে আর বেশি কথা কী, একদিন দেখা করিয়ে দেব’। তা, তোমার লজ্জা হয় তো দেখা নাই হল।”