হরিমোহিনী কৈলাসের গ্রাম্যতায় বিস্ময় প্রকাশ করিয়া কহিলেন, “বল কী ঠাকুরপো সাত-আট হাজার টাকা কী! বিশ হাজার টাকার এক পয়সা কম হবে না।”
কৈলাস অত্যন্ত মনোযোগের সহিত চারি দিকের জিনিসপত্র নীরবে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। এখনই সম্মতিসূচক একটা মাথা নাড়িলেই এই শালকাঠের কড়িবরগা ও সেগুনকাঠের জানলা-দরজা-সমেত পাকা ইমারতটির একেশ্বর প্রভু সে হইতে পারে এই কথা চিন্তা করিয়া সে খুব একটা পরিতৃপ্তি বোধ করিল। জিজ্ঞাসা করিল, “সব তো হল, কিন্তু মেয়েটি?”
হরিমোহিনী তাড়াতাড়ি কহিলেন, “তার পিসির বাড়িতে হঠাৎ তার নিমন্ত্রণ হয়েছে, তাই গেছে— দু-চার দিন দেরি হতে পারে।”
কৈলাস কহিল, “তা হলে দেখার কী হবে? আমার যে আবার একটা মকদ্দমা আছে, কালই যেতে হবে।”
হরিমোহিনী কহিলেন, “মকদ্দমা তোমার এখন থাক্। এখানকার কাজ সারা না হলে তুমি যেতে পারছ না।”
কৈলাস কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া শেষকালে স্থির করিল, নাহয় মকদ্দমাটা এক তরফা ডিগ্রি হয়ে ফেঁসে যাবে। তা যাক্ গে। এখানে যে তাহার ক্ষতিপূরণের আয়োজন আছে তাহা আর-একবার চারি দিক নিরীক্ষণ করিয়া বিচার করিয়া লইল। হঠাৎ চোখে পড়িল, হরিমোহিনীর পূজার ঘরের কোণে কিছু জল জমিয়া আছে। এ ঘরে জল-নিকাশের কোনো প্রণালী ছিল না; অথচ হরিমোহিনী সর্বদাই জল দিয়া এ ঘর ধোওয়ামোছা করেন; সেইজন্য কিছু জল একটা কোণে বাধিয়াই থাকে। কৈলাস ব্যস্ত হইয়া কহিল, “বউঠাকরুন, ওটা তো ভালো হচ্ছে না।”
হরিমোহিনী কহিলেন, “কেন, কী হয়েছে?”
কৈলাস কহিল, “ঐ-যে ওখানে জল বসছে, ও তো কোনোমতে চলবে না।”
হরিমোহিনী কহিলেন, “কী করব ঠাকুরপো!”
কৈলাস কহিল, “না না, সে হচ্ছে না। ছাত যে একবারে জখম হয়ে যাবে। তা বলছি, বউঠাকরুন, এ ঘরে তোমার জল ঢালাঢালি চলবে না।”
হরিমোহিনীকে চুপ করিয়া যাইতে হইল। কৈলাস তখন কন্যাটির রূপ সম্বন্ধে কৌতূহল প্রকাশ করিল।
হরিমোহিনী কহিলেন, “সে তো দেখলেই টের পাবে, এ পর্যন্ত বলতে পারি তোমাদের ঘরে এমন বউ কখনো হয় নি।”
কৈলাস কহিল, “বল কী! আমাদের মেজোবউ— ”
হরিমোহিনী বলিয়া উঠিলেন, “কিসে আর কিসে! তোমাদের মেজোবউ তার কাছে দাঁড়াতে পারে!”
মেজোবউকেই তাহাদের বাড়ির সুরূপের আদর্শ বলাতে হরিমোহিনী বিশেষ সন্তোষ বোধ করেন নাই—” তোমরা যে যাই বলো বাপু, মেজোবউয়ের চেয়ে আমার কিন্তু ন’বউকেই ঢের বেশি পছন্দ হয়।”
মেজোবউ ও ন’বউয়ের সৌন্দর্যের তুলনায় কৈলাস কিছুমাত্র উৎসাহ বোধ করিল না। সে মনে মনে কোনো একটি অদৃষ্টপূর্ব মূর্তিতে পটল-চেরা চোখের সঙ্গে বাঁশির মতো নাসিকা যোজনা করিয়া আগুল্ফবিলম্বিত কেশরাশির মধ্যে নিজের কল্পনাকে দিগ্ভ্রান্ত করিয়া তুলিতেছিল।
হরিমোহিনী দেখিলেন, এ পক্ষের অবস্থাটি সম্পূর্ণ আশাজনক। এমন-কি, তাঁহার বোধ হইল কন্যাপক্ষে যে-সকল গুরুতর সামাজিক ত্রুটি আছে তাহাও দুস্তর বিঘ্ন বলিয়া গণ্য না হইতে পারে।